Also read in

করোনা আক্রান্ত এই পৃথিবীতে আমাদের চারপাশ দ্রুত পাল্টাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের অনুভূতি,চিন্তাধারা।এই সময়কে ধরেই মিথিলেশ ভট্টাচার্যের গল্প পূর্ণগ্রাস করোনা

পূর্ণগ্রাস করোনা
মিথিলেশ ভট্টাচার্য

ঘাস বোঝাই চটের বস্তা বঙ্কু’র শাটার নামানো দোকানের সিড়িতে রেখে তাতে মাথা দিয়ে ড্রেনের ঢাকনার উপর পা মেলে শুয়েছিল মনতাই। আদল গা, পরনে আধময়লা নীল রঙ্গের চেক লুঙ্গি। মুখের কালো মুখোশ থুতনিতে নামানো, হঠাৎ করে তাকালে মনে হবে একগুচ্ছ সৌখিন দাড়ি।

পাশের দোকান থেকে দু প্যাকেট চিপস কিনে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে অলকেশের চোখ পড়ে পা’ টান করে শোয়া মনতাইয়ের ওপর।

ওকে দেখে মুখে একটু হাসি টেনে অলকেশ বলে, আরে মনতাই যে-!

ওয়। ভালা আছোনি- মনতাইও স্মিত হেসে জবাব দেয়।
আছি। বেশ ক’দিন থেকে তোমার কথা ভাবছিলাম।
কেনে-?
মাছের জন্য। এখন বুঝি আর মাছ ধরো না-?
না। অখনো নদীতে বড়শি বাওয়ার সময় অইছেনা-‌।
তাহলে করো কি-?
আমার দুইটা গরু আছে। তারারে লইয়া দিন কাটাই- তারারে হিনান করাই, জাবনা দেই আর বেইল পড়লে দুধ খিরাই’–
বাহ্, খুব ভাল,- অলকেশ বলে।
আপনে কেমন আছইন দাদা-? আছি, ভালো আছি-।
কথা বলতে গিয়ে অলকেশ লক্ষ্য করে মনতাইয়ের চাপা ঠোঁট দুখানা পানের শুকনো রসে রাঙানো। তখন তার মনে পড়ে এখন তো রমজান মাস- সে মনতাইকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি রোজা রাখো না মনতাই?
রাখি তো দাদা-।
তোমার ঠোঁট কেন লাল তবে-?
ওহ্, পতা খাওয়ার বাদে পান চিবাইছলাম,তার চিন্ রই গেছে- কথার শেষে মনতাই একটু হাসে-।

বেশ কদিন তোমাকে মনে পড়ছিল- আজ দেখা হয়ে গেল- ভালো থেকো,- বলে সামনে এগোয় অলকেশ।

গলি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মমতাইয়ের কথা ভাবে অলকেশ।
ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল এই শহরতলীতে এসে ঘর বেঁধেছে অলকেশ ও তার অতি ঘনিষ্ঠ সহকর্মী কজন। ওদের দেখে পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই এসেছে এখানে। প্রধান সড়কের কাছে বহুদিন থেকে পড়ে থাকা উঁচু নিচু বিশাল এলাকা বর্তমানে শহরের অনেক গণ্যমান্য, বিশিষ্ট ব্যক্তির হটস্পট-!

অলকেশের গড়ে ওঠা নতুন কলোনির চারপাশে বিস্তর গরিব হিন্দু, মুসলমান, বিহারি, উড়িয়া আর চা বাগিচার ছাঁটাই শ্রমিকদের ছড়ানো ছেটানো বসতি-।

বলতে গেলে এখানে শুরুর দিন থেকেই ওই গরিব গুর্বো গতর খেটে খাওয়া লোকেদের সঙ্গে পরিচয় অলকেশের- মনতাই, হরি,মুরলি, রায়না, মাখনা, কালা, বাবুল,নাজু আরো অনেক অনেক-। আর শুধু পরিচয় না, অঙ্গাঙ্গী ছন্দবদ্ধ জীবনযাপন-।

মনে পড়ে অলকেশের, বিরানব্বুই ইংরেজির এক দাঙ্গা ও গুজব বিধ্বস্ত শীতার্ত সময়ের কথা। গোটা শহর ও শহরতলি যখন মিথ্যা গুজবের তাণ্ডবে থরহরি কম্পমান তখন কোনো এক সন্ধ্যাবেলা পাশের কফিউরা টিলার মুসলমান পাড়ার ঘরের বউ- ঝি ও বাচ্চা কাচ্চারা হঠাৎ ‘আইছে’ ‘আইছে’ চিৎকার শুনে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে এসেছিল অলকেশদের ঘরে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ওরকম হঠাৎ ওই হুলুস্থুলে তার বউ ও মেয়ে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

ওই দিন সন্ধ্যায় খলুই ভর্তি মাছ নিয়ে অলকেশদের উঠানে হাজির হয়েছিল মনতাই- অপেক্ষা করছিল অফিস ফেরতা দাদা’র জন্য, আর তখুনি ওই আচম্বিত ঘটনা।সেও প্রথমে খুব হকচকিয়ে গেছিল। তারপর সবাইকে সামলানোর কাজে লেগে গিয়েছিল। তারপর অলকেশের স্ত্রী ও মেয়েকে অভয় দিয়ে বলেছিল, বউদি, তুমি ভাতিজিরে লইয়া ঘরোর ভিতরে দরজা বন্ধ করিয়া থাকো- আমি বাইরে আছি- এই বান্দারে ঘায়েল না করিয়া তুমরারে কেউ কিচ্ছু করতে পারত নায়-।

ওরকম কত কত ছোট- বড় ঘটনা-।

মনতাই আর সাথী তইবুর দুই তুখোড় বড়শিয়াল। প্রায় প্রথমদিন থেকেই দেখেছে অলকেশ, নদী-নালা -হাওড় বা বিল থেকে মাছ শিকার করে এনে দু’জন পাড়াতেই এর ওর বাড়িতে বিক্রি করত। কত সুন্দর সুন্দর টাটকা মাছ। ঘোলা ট্যাংরা, বাচা, গলদা চিংড়ি, বোয়াল; বরাকের বিখ্যাত রাঙ্গাচোখ রুই-।

প্রায়ই মাছ নিয়ে প্রথমে চলে আসত অলকেশদের ঘরে। ভাল, টাটকা, জ্যান্ত মাছ হলে তো কথাই নেই।
বাবু পরথম তুমি রাখিলাও, পরে অন্যের কাছে বেচমু-।
মনতাই আর তৈয়বুর দু’জনই এক বায়না করত অলকেশের কাছে।

বেশ ক’বছর আগে, কথাগুলো এখনও ভুলতে পারেনি অলকেশ, একদিন দুপুর বেলা মনতাই এসে হাজির তার কাছে। বেশভূষা আজকের মতোই। আদলগা, পরনে লুঙ্গি।
কি ব্যাপার-?

ঠেলা চালক পাতলা’র সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে কিনা অলকেশকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছে মনতাই।

পাতলা বা পেটলা- এ নামেই কৃশকায় শ্যাম বর্ণ ছেলেটি এলাকায় সবিশেষ পরিচিত। প্রথম থেকেই ঠেলা চালক সে। খেয়ে পরে বেশ দু পয়সা হাতেও থাকে। স্বভাব চরিত্রও ভাল। ছোট বড় সবাইকে সমীহ করে, আদব-কায়দা জানে।

দাও না মেয়ের বিয়ে, ছেলে তো ভালোই-।
আপনে যখন কইরা তখন পাতলার হাতোউ মেয়েরে দিমু-
হ্যাঁ হ্যাঁ দাও- অলকেশ দ্বিধাহীন কন্ঠে বলেছিল।

দাদা আপনে আর বউদিয়ে দোয়া করইন যে-
আবেগ তাড়িত গলায় বলেছিল মনতাই।

||২||

এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস সংক্রমণের দিনে- লকডাউনের প্রথম পর্বে অলকেশকে মাছ যোগান দিয়েছিল সেলিম- মনতাইয়ের ভাইপো-অলকেশের গাড়ির ড্রাইভার-।

সাইকেলের দু দিকের হ্যান্ডেলে সবজির ঢাউস থলে ঝুলিয়ে অলকেশের বাড়িতে প্রথম যে ঢুকেছিল, সে বোদাই কালা। মূলত সে রংমিস্ত্রি। কিন্তু লকডাউনের সময়ে পাড়া-বেপাড়ার মানুষেরা বাড়ি ঘরের কাজ শিকেয় তুলে বন্ধ ঘরে বসে আছে ভয়ে- আতঙ্কে- তবে কালাদের মত দিনমজুরেরা বাঁচবে কেমন করে?
তাইতো ভিন্নতর জীবিকার সন্ধান-। কলিং বেল টিপে অলকেশকে ডেকেছিল কালা। আর ওকে দেখে সে তো অবাক!

কিরে তুই শাক-সবজি বিক্রি শুরু করলি কবে!
বেশ দিন অই গেছে বাবু- পেটের দায়ে না বার অইয়্যা উপায় আছে নি?
তা কি সবজি এনেছিস?
দাড়াইন দেখাইয়ার- বলে হ্যান্ডেল থেকে সবজির থলি দুটি নিচে নামায়। তারপর থলের ভেতরে হাত ভরে একে একে বার করতে থাকে পালই শাক, বেগুন, ভেন্ডি, চালকুমড়া, কাঁচা লঙ্কা।

সবগুলোই অলকেশের পছন্দের সব্জি। সে বেশ কিছু নিয়ে ছিল ওর কাছ থেকে।

যাবার কালে কালা তাকে মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিল, আমারে ফোন করলেউ অইব- ঘর থাকিয়া বাইরইবা না কাকু-।

যেমন রংমিস্ত্রি খুড়ি বোদাই কালা তেমনি খোদ সরকার বাহাদুর, পাড়াপড়শি সকলের মুখে এক কথা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের দরজা পার করবেন না।

মনে পড়লো অলকেশের, একটু আগে যখন সে দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে চিপস কিনছিল তখন করোনা সম্পর্কিত একটা কথা কানে এসেছিল তার। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে একজন লোক আরেকজনকে বলছে, জানিস,কলির পর বলি- এখন বলির যুগ – সব ধ্বংস হয়ে যাবে-।

||৩||

ঘরে এসে ঢুকতেই মেয়ে অঙ্কিতা বলে, বাবু, তোমার একটা ফোন এসেছিল-

কে করেছিল রে-?
-তোমার বন্ধু, বিকাশ কাকু-
-ও, সেই ভীতুর ডিমটা-?
অলকেশের কথা শুনে মেয়ে হিহি করে হাসে-।
কিছু বলেছে-?
না, শুধু বললেন, ঘরে এলে ওকে একটু ফোন করতে বল-
ঠিক আছে, মোবাইলটা এনে দে-

কয়েক মুহুর্ত পর মেয়ে বাবাকে মোবাইল এনে দেয়।
মোবাইল চালু করে অলকেশ বন্ধু বিকাশকে বলে, কিরে, ফোন করেছিলি?
হ্যাঁ তোদের কুশল মঙ্গল জানতে চাই, কেমন আছিস?
ভালই তো-।
এখনতো লকডাউন অনেকটা উঠেছে- তোর তো হুটহাট করে বাইরে বেরোনোর অভ্যাস-
তা ঠিক- বিকাশকে কথা শেষ করতে দেয় না অলকেশ। বলে, কাঁহাতক আর ঘরে বসে থাকা যায় বন্ধু?
তা বুঝি, তবে সাবধানে বেরোস- আর হ্যাঁ নতুন ড্রাইভার পেয়েছিস?
মানে- বেশ অবাক হয় অলকেশ।

বিকাশ বলে, আমি তো সব পুরনোদের ছাঁটাই করে দিয়েছি। দুবেলার ঝি, রান্নার লোক, ড্রাইভার- তোর তো আবার ভিন্ন গোত্রের ড্রাইভার, তাই বলছি না ছাঁটলে এক্ষুনি সবাইকে ছেঁটে নতুন লোক রাখ-।

এসব কি বলছে বিকাশ- ওর কি ঘরে বসে থাকতে থাকতে সামাজিক ব্যবধানের প্রবল চাপে অবসাদ অবসন্নতায় করোনা আতঙ্কে মাথা খারাপ হয়ে গেছে- ও নিজেই তো বলেছে ঘরের চৌকাঠের বাইরে পা রাখে না, আবাসনের গেটম্যানকে দিয়ে চাল- ডাল- তেল-সব্জি আনিয়ে বাইরের বারান্দায় দুদিন ফেলে রাখে- দৈনিক কাগজ রাখাও বন্ধ করে দিয়েছে- এক কথায় করোনা জুজুর ভয়ে বাইরের জগৎ তার কাছে বন্ধ-।

ওসব কথা ভাবতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য অলকেশের চারপাশ যেন এক আদিম অন্ধকারে গ্রাস করে- চারপাশের আলো- হাসির গান, জীবনের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-বেদনা সবকিছু যেন নিমেষে এক অদ্ভুত আঁধারে বর্ণহীনতায় হারিয়ে যায়।

এই গল্পের লেখক মিথিলেশ ভট্টাচার্য দীর্ঘ কাল ব্যাপী তপোধীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে গল্পের কাগজ ‘শতক্রতু’ সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও ‘পরম্পরা’ নামে একটি গদ্যের কাগজের একক সম্পাদনা করেছেন। এখন পর্যন্ত তার পাঁচটি গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

 

Comments are closed.