ভিত্তি বর্ষ ১৯৫১! ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ সংরক্ষণ! 'ফাঁস' হওয়া রিপোর্টের ছয় নং ধারা নিয়ে কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা
১৯৮৫ সালে পাশ হওয়া অসম চুক্তির ৬-নম্বর ধারা বাস্তবায়নের আশ্বাস নরেন্দ্র মোদি বরাকের মাটিতে দাঁড়িয়েই দিয়েছিলেন। এতে স্থানীয় দর্শকরা উচ্ছ্বসিত হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তারা অবশ্যই অজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীতে কেন্দ্র সরকারের নির্দেশে ১৪ জনের একটি হাইলেভেল কমিটি গঠিত হয়। তাদের বলা হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে ৬ নম্বর ধারা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের রিপোর্ট পেশ করতে। রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বরাক উপত্যকা থেকে এই কমিটিতে কোনও সদস্য ছিলেন না। কমিটির সদস্যরা শুধুমাত্র একবার বরাক উপত্যকা পরিদর্শন করে গেছেন।
মঙ্গলবার গুয়াহাটিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থার প্রতিনিধি, আইনজীবী নিলয় দত্ত সহ কয়েকজন মিলে একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কমিটির প্রস্তাবিত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। তাদের অভিযোগ সরকার সময়মতো এটি প্রকাশ করছে না, ফলে তারা জনসমক্ষে এটি তুলে ধরতে বাধ্য হচ্ছেন। উল্লেখ্য, সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই হাইলেভেল কমিটির সদস্য।
জনসমক্ষে তুলে ধরা রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজ্যে অসমীয়া সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভিত্তি বর্ষ হবে ১ জানুয়ারি ১৯৫১ সাল। যারাই এর আগে এরাজ্যে প্রবেশ করেছেন বা আগে থেকে বসবাস করেছেন এবং তাদের বংশধরেরা অসমীয়া সংজ্ঞা পাবে। চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জন্য ৮০ শতাংশ, ভোটে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকার প্রস্তাব রয়েছে।
যদিও বরাক উপত্যকার বিজেপির প্রতিনিধিরা বলছেন এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়, এতে কারও স্বাক্ষর নেই ইত্যাদি, তবে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের কার্যালয় থেকে এব্যাপারে একটি প্রেসবার্তা জারি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রাজ্য সরকার প্রত্যেক অসমীয়া নাগরিককে সুরক্ষা দেবে, ফলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এব্যাপারে কোনও কথা না বললেও অনেকেই এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। প্রাক্তন সাংসদ সুস্মিতা দেব, অধ্যাপক তথা রাজনৈতিক সমালোচক জয়দীপ বিশ্বাস, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক তপোধীর ভট্টাচার্য, বরাক উপত্যকার ছাত্র আন্দোলন অন্যতম প্রতিষ্ঠিত নাম তথা গৌহাটি হাইকোর্টের প্রাক্তন আইনজীবী প্রদীপ দত্ত রায়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আগামীতে এই বিষয়ে সমাজের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলাপচারিতা হবে। দেখা যাক তারা কি বলছেন:
তপোধীর ভট্টাচার্য, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ও কবি :
এধরনের সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারের আমলে উঠে আসার সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল। এখন তারা আর লজ্জা পাচ্ছে না, মুখোশের আড়ালে না থেকে সরাসরি ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই মহামারীর সময়ের সুযোগ নিয়ে যেভাবে রাজ্যের বাঙ্গালীদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সরাসরি চক্রান্ত শুরু হয়েছে, এতে ঘেন্না হয়। তারা নতুন করে ইতিহাস লিখছেন, ১৯৫১ সালের আগে যারা এসেছেন তাদের অসমীয়া বলছেন, আর বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক! বাঙালিরা এই ভূখণ্ডে এর অনেক আগে থেকেই ছিল, তবে কেন সংজ্ঞা নির্ধারণে অসমীয়া শব্দ ব্যবহৃত হবে? এই ভুখন্ডে বসবাসকারী বাঙালিরা ১০০ শতাংশ এই অঞ্চলের নাগরিক, তাদের ভিটেমাটিহীন করে তোলার এই চক্রান্ত বর্বরোচিত। আমাদের প্রতিনিধিরা শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছেন, তাদের কাছে মাথা নত করেছে। যাদের মাথায় ছিটেফোঁটা বুদ্ধি আছে তারা হয়ত প্রতিবাদ করবেন কিন্তু এতে খুব একটা লাভ হবার নয়। ভাষার গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রকাশ্যে অধিকার হরণের সিদ্ধান্ত হয়তো পৃথিবীতে আগে কোথাও নেওয়া হয়নি।
শিলচরের প্রাক্তন সাংসদ তথা জাতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুস্মিতা দেব :
আমি আগেও বলেছি, অসম রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর জনগণ একসঙ্গে বসবাস করছেন। এক ভাষার উপর ভিত্তি করে সংজ্ঞা নির্ধারণ কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। আমরা জানি সংরক্ষণ ব্যাপারটা হচ্ছে যারা অল্পসংখ্যক তাদের সুরক্ষার জন্য, তবে যে রিপোর্ট আজকে বেরিয়েছে এতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের সব থেকে বড় ভাষাগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব রাখা হচ্ছে, এটা কিছুটা হাস্যকর। তারা বলছেন, বরাক উপত্যকা এবং বোড়োল্যান্ডকে বাদ দিয়ে বাকি অংশে অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক হবে। তাদের এটুকু জেনে রাখা উচিত ওইসব অঞ্চলেও বিরাট সংখ্যক বাঙালি এবং অন্য ভাষাগোষ্ঠীর জনগণ বসবাস করছেন। তাদের ওপর ভাষা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। আর জোর করে কোনও ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলা যায় না, সহাবস্থানে এটা সম্ভব হয়।
এবার আসা যাক বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রে, সম্প্রতি আমরা দেখেছি প্রত্যেক সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বরাক উপত্যকাকে অপেক্ষা করা হয়েছে। হাজারখানেক পদে চাকরি হয়েছে অথচ বরাক উপত্যকার একজনকেও চাকরি দেওয়া হয়নি। এবার অসমীয়াদের জন্য ৮০ শতাংশ সংরক্ষণ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের শিক্ষিত যুব সমাজ আর সরকারি চাকরি পাবে না। এই প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে না এলেও যদি আগামীতে এটা কেন্দ্র সরকার অনুমোদন পায় তবে আইন হিসেবে স্বীকৃত হবে। যদি এই ধারা গড়ে ওঠে যেখানে অসমীয়ারাই আসামে চাকরি পাবে তাহলে ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ানক দৃষ্টান্ত রাখা হবে। এবার যদি পাঞ্জাবে বা মহারাষ্ট্রে একই ধরনের আইন গড়ে ওঠে এবং সেখান থেকে অসমের সন্তানদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তার জন্য দায়ী হবে বর্তমান সরকারের এই সিদ্ধান্ত।
জয়দীপ বিশ্বাস, অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপক তথা জাতীয় স্তরের লেখক ও সমালোচক :
এই প্রস্তাব পাশ হলে রাজ্যে দুই ধরনের নাগরিক থাকবেন, প্রথম শ্রেণীতে যারা ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিকের মত প্রতিটির সুবিধা ভোগ করবেন। তারা ভোট দিতে পারবেন, ভোটে লড়তে পারবেন, সরকারি চাকরির যোগ্যতা রাখবেন, নিজের ইচ্ছেমত জমি কিনতে পারবেন ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে যেসব নাগরিকরা পড়বেন, যাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৫১ সালের ১লা জানুয়ারির পরে এই রাজ্যে এসেছেন, তারা শুধু রাজ্যে বসবাস করবেন কোনও অধিকার থাকবে না। প্রস্তাবটি আসু এবং তার সহযোগীরা প্রকাশ্যেই লিক করেছেন। একটি ছোট্ট পিডিএফ প্রত্যেকের মোবাইলে এসে গেছে, কিন্তু ১৪১ পাতার একটি বিস্তারিত প্রস্তাবপত্রও তারা জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। তাদের যুক্তি, “সরকারের পক্ষ থেকে অহেতুক দেরি হচ্ছে এবং এই প্রস্তাব বর্তমানে কোথায় রয়েছে তারা জানেন না।”
১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত অসম চুক্তিতে আসুর সম্মতি ছিল। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তীতে অসম চুক্তির ভিত্তিতে রাজ্যে এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এবার তারাই ভিত্তিবর্ষ পরিবর্তনের কথা বলছেন। এই প্রস্তাব প্রথমে অসম চুক্তির পরিপন্থী, সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্র, ভারতীয় সংবিধান, এমনকি মানবাধিকারের পরিপন্থী। তবে যারা ক্ষমতায় বসে আছেন তাদের হয়তো মানবাধিকার বা ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আর আমাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এব্যাপারে প্রায় পাকাপাকিভাবেই নিরব।
এবার আসা যাক যারা ১৯৫১ সালের আগে এই ভূখণ্ডে বসবাস করছিলেন তাদের কথায়। বলা হচ্ছে, এরা প্রত্যেকেই এই রাজ্যে অসমীয়া পরিচয়ে বসবাস করবেন। যারাই এরাজ্যে বাস করেন তাদের সকলের পরিচয় অসমীয়া হতে পারে না। দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ভাষা গোষ্ঠী হিসেবে অসমে বাঙালির সংখ্যা অসমীয়া থেকে খুব একটা কম নয়। একজন মানুষ ভারতবর্ষের একটি রাজ্যে বাঙ্গালী পরিচয়ে কেন সাধারণ অধিকার ভোগ করতে পারবে না? এটা একেবারেই স্পষ্ট নয়। ফলে প্রস্তাবটি আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। যদি কেন্দ্র সরকার এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়, তবে চিরাচরিত নিয়মে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রাজ্যে বসবাসকারী বাংলা ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ।
আসুর বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী জনগণের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেউ যেন আতঙ্কিত না হন, রাজ্যে একজনও অসমীয়া মানুষের অধিকার খর্ব হতে দেবেন না তিনি। এই বার্তাটিও অসমীয়া ছাড়া রাজ্যের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধার নয়।
প্রদীপ দত্ত রায়, গৌহাটি হাইকোর্টের প্রাক্তন আইনজীবী তথা ছাত্রসংগঠন আকসার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক :
আসুর নেতৃত্বে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ রেখে যে ভূখণ্ডের নাগরিকত্ব নির্ধারণের প্রস্তাব তারা দিয়েছেন, সেটা অসম চুক্তিরও পরিপন্থী। ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তি বিল হিসেবে পাস হয়, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পাওয়ায় আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছে রাজ্যে নাগরিকত্বের ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সাল। চুক্তিটি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে আসুর সম্মতি ছিল। এবার তারাই আবার ভিত্তিবর্ষ পরিবর্তন করে নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। তারা নিজেরাই জানেন না, যে ‘অসমীয়া’ শব্দ নিয়ে এত লম্ফঝম্প করেন এর সংজ্ঞাটা কি? যেহেতু অসমচুক্তি একটি আইন, ফলে হঠাৎ করে ভিত্তিবছর পরিবর্তন আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। আমার ধারণা কেন্দ্র সরকার এই প্রস্তাব খারিজ করবে। যদি সেটা না হয়, আমি আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে এর বিরোধিতা করব।
যদি এই প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে অনুমোদন পায়, তবে প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে এক হয়ে এর বিরোধিতায় প্রকাশ্যে নামতে হবে। আসামে কখনই এক ভাষার ভিত্তিতে কোনও আইন গড়ে উঠতে পারে না, কারণ এখানে নানান ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ পাশাপাশি সহাবস্থানে বসবাস করছেন। ভারতীয় সংবিধানের অধীনে প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা দেশের কর্তব্য। ফলে এই প্রস্তাব কোনভাবেই টিকবে না।
Comments are closed.