Also read in

মানুষের জন্যই আসলে বাঁচে মানুষ! এটাই পাঠ করোনা রাক্ষুসির

পুড়ে পুড়ে স্বণ হোক যত সম্মিলিত পাপ।

কেন জানি না, এই পংক্তিটা বিদ্ধ করছে আমার যাবতীয় বোধ। আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ। আবার স্বঘোষিত র‍্যাশনালও। যুক্তি, সায়েন্সে আস্থাশীল। ঈশ্বরবিশ্বাস আর যুক্তিবাদের নিরন্তর দ্বন্দ্বে দীর্ণ এক দুর্বল চিত্ত এক অসহায় মানুষ।

পাপপুণ্যের নিক্তি আমাকে নিয়ত দোলাচলে রাখে। কেন জানি মনে হয়, হিসাব নিচ্ছে কেউ। কেউ!?
হ্যা, কেউ।

মনে হয়, কোথায় যেন একটা শোধবোধের শর্ত ছিল। দায় ছিল। আজন্ম আমি এই শর্ত ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলেছি এমন এক গন্তব্যের দিকে, যে-গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এই সময়, নির্ধারণ করে দিয়েছে সায়েন্স। এবং হ্যা, ধর্মও। ফলে যত আমি আমার অভীষ্ট ‘আলোকিত’ গন্তব্যের দিকে সদর্পে এগিয়েছি, বা এগিয়েছি বলে এক ভ্রমের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খেয়েছি আর এই ভুলভুলাইয়াকেই অভীষ্ট ধরে নিয়েছি, ততই যেন নিক্তিটা পাপের দিকে আরও আরও ঝুঁকে পড়েছে। ভ্রম, যাবতীয় জাগতিক ভ্রম আমাকে অন্ধ করে রেখেছে। এই দায় আসলেই প্রকৃতির কাছে। মানুষের কাছে। হ্যাঁ, ধর্মের কাছে তো বটেই। বা বলা ভালো, ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের কাছে।

গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনা শাহজাদির প্রলয় নৃত্য এই ভয়ংকর প্রশ্নের মুখে দাঁঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। হ্যাঁ, ‘আমাদের’। ‘আমাদের’ শব্দটি এর আগে আর কখনও কি এতটাই বহুবচন হয়ে উঠতে পেরেছিল? ‘আমি’র গণ্ডি ছাড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কি এর আগে কখনও এমনভাবে বহুত্বের কথা ভেবেছে? মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কি কখনও এমন আরশির সামনে যেখানে শুধু মরিয়া মানুষ নিজেকে ব্যাধিমুক্ত দেখতে চাইছে, আর আয়নায় প্রতিবিম্বিত হচ্ছে আবিশ্ব মানুষ। গুনে শেষ করা যায় না এত মানুষ৷ এ যেন সভ্যতার বিশ্বরূপদর্শন।

সভ্যতা, বস্তুত, আগ্রাসী। সর্বগ্রাসী। স্বভাব-কলম্বাস মানুষের অভিযান থেকে নিস্তার নেই যেন মহাবিশ্বেরও। এই লোলুপ অভিযানকেই সভ্যতার সংজ্ঞা বলে নিয়ত ভ্রম করে চলেছে মানুষ। আসলে সভ্যতা যেন এক শাপগ্রস্ত অগস্ত্য মুনি, যে জানে না নিজের গন্তব্য। করোনা এই শাপেরই এক জারজ সন্তান।

এই শাপমোচনের পথ কিন্তু দেখিয়ে দিচ্ছে আরশিতে প্রতিবিম্বিত ‘আমাদের’ বহুত্ব। পাশেরজন আক্রান্ত হলে আমারও নিস্তার নেই, এই চরম সত্য সভ্যতার ডেফিনেশনকেই আমূল পালটে দিচ্ছে। ধারাভির বস্তিতে কোনও ব্রাত্যজনের মৃত্যু মায়ানগরির উচ্ছ্বল জীবন তরঙ্গে এমনভাবে আছড়ে পড়বে, করোনা-পূর্ব সময়ে তা কি ভেবেছিল কেউ? নিজামুদ্দিন মরকজের অপরিণামদর্শী ধর্মান্ধ কিছু মানুষকে অন্য ধর্মের মানুষ তোড়ে অভিসম্পাত দিচ্ছেন। কিন্তু একই সঙ্গে এঁদের আরোগ্যও তো চাইতে হচ্ছে। চাইতেই হচ্ছে। এ তো আদ্যোপান্ত পরস্পর বিরোধিতা। কিন্তু এটাই করোনা-পাঠ। কীভাবে? না, লকডাউন-বন্দি মানুষকে প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করতে হচ্ছে যে, পাশের জন ভাইরাস -আক্রান্ত হলে, নিস্তার নেই তারও। শুধু পাশের জনই নয়, পাশের জনের পাশের জন। তারও পাশের জনের পাশের জন। দিগন্ত বিস্তৃত এক শেষহীন পাশের জন।

করোনা-কাল বস্তুত এক বৈপরীত্যেরও অদ্ভুত সময়। ভাবুন তো, টিভিতে অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে ফেসবুকে টুনির মা, মোদি থেকে শুরু করে মমতা, সব্বাই পইপই করে বলছেন, মানুষ থেকে দূরে থাকুন। সযত্নে সতর্কে এড়িয়ে চলুন মানুষের সাহচর্য। কাকে বলছেন? বলছেন সেই মানুষকেই যাঁরা জীবনে যত বেশি উন্নতি করছেন, তত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন তাঁর পাশের জনের কাছ থেকে। এই পাশের জনের মধ্যে তাঁর রক্তের সম্পর্কের পরিজনও থেকে যাচ্ছে। তো সেই মানুষকেই এখন নিয়ম মেনে মানুষের সংস্পর্শ বর্জন করতে হচ্ছে।

প্রতিশোধের তত্ত্বটা এই মোড়ে এসেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রতিশোধ প্রকৃতির। প্রতিশোধ মানবিকতার। প্রতিশোধ ভ্রান্ত সংজ্ঞায়িত সভ্যতার। করোনা থেকে বাঁচতে মানুষ যত মরিয়া শারীরিকভাবে মানুষ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, ততই মানুষের মন আকুলভাবে মানুষেরই সংস্পর্শ চাইছে। চাইছে, যার সঙ্গে স্বেচ্ছায় অনিচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, যে বিচ্ছিন্নতাকেই সভ্যতার অনিবার্য শর্ত বলে ধরে নিয়েছিলেন, করোনা-কালে সেই মানুষের সঙ্গেই সংযোগ চাইছেন তাঁরা।

এবং ঠিক এইখানেই মানুষ জিতে বেরিয়ে আসবে। ঠিক বেরিয়ে আসবে। কারণ প্রকৃতি মানুষকে উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিকে কীভাবে জয় করতে হয়, একমাত্র মানুষই তা জানে। বিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে সভ্যতার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। ভাইরাসের প্রতিষেধক একদিন ঠিক বের হবে।

এই জগতে,শুনেছি, সব কিছুই নাকি পূর্বনির্ধারিত। Pre-destined.এই লকডাউন যেন অনেক আগেই কোনও বিধাতা লিখে রেখেছিলেন দুর্দমীয় সভ্যতার ললাটে। এই যে আমার কর্মব্যস্ত জীবনে হঠাৎ এই দুর্বহ নিস্তরঙ্গতার বেড়ি, এটাও ললাটলিখন। পূর্ব নির্ধারিত। এই যে আমার পাড়ার সেলুনের অবিনাশ প্রতি সন্ধ্যায় ফোন করে জিজ্ঞেস করে, স্যর মাছ লাগলে বলুন, শেষ রাতে দুধপাতিল যাব, সকাল সকাল মাল নিয়ে আসব, লাগলে এক্ষুনি অর্ডার দিয়ে দিন….অবিনাশের দোকান বন্ধ আজ একুশ দিন, অগত্যা পেশাবদল। এ সবই pre destined. বা প্রদীপ দাস। রংমিস্ত্রি। প্রদীপ ফোন করে, স্যর নববর্ষ, পাঁঠা লাগলে বলুন। মিজোরামে রাস্তার কাজ করতে গিয়ে আটকে গেছে শামিম। ওই আরকাটিপুর পেরিয়ে কোথায় যেন থাকে। ভাগচাষি। কাজ না থাকলে শহরে আসে, জন খাটে। আমাদের আবাসনে আসে, কেউ সিলিং ফ্যান সাফ করান, কেউ বাথরুমের টাইলস ধোয়ান। এখন প্রতি রাতে ফোন করে, মোদি আজকে কিছু কইলা নি? খুলবনি স্যার বনধ ইগু?

বা বরজুরাইর ফয়জুল হক, করোনায় মৃত্যু হল যাঁর। পরিজন বর্জিত জানায় শোককে ছাপিয়ে গেল স্পর্শভয়। ওই যে ইটরকান্দির ডায়েট সেন্টারের জানালা দিয়ে তাঁর ছেলে আমিরুল যখন দেখছেন, মহাকাশচারীর পোশাক পরে কারা যেন তাঁদের আব্বার পলিথিনে মোড়া দেহটি ত্রস্ত ব্যস্ততায় কবরে শুইয়ে দিচ্ছেন, তখন কি তাঁরাও ভাবছেন, আব্বার নসিবে এটাই লিখে রেখেছিলেন আল্লাহতালা?

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জানাজায় আসতে হল এই যে লোকগুলোকে, এঁদের কী ধর্ম, তাঁরা মাটি দেওয়ায় ধর্মচ্যুতি ঘটল কি? ডায়েটে কোয়ারান্টাইন-বন্দি ফয়জুল সাহেবের বিবি কি ওই রাতের চেয়েও অন্ধকার সকালে নিজের নসিবের দিকেই তখন তর্জনী তুলেছিলেন অগোচরে?

বা সেই হিন্দু বৃদ্ধার কথাই ধরুন না। তাঁর শেষযাত্রায় কাঁধ দেবেন মহল্লার মুসলিমরা, এমন ললাটলিখনের কোনও আঁচ কি কখনও পেয়েছিলেন তিনি? মুসলমানের ছোঁয়ায় অশুচি হয়ে গেল কি তাঁর অন্ত্যেষ্টি? এ সবই কি ললাটলিখন নয়?

বা ভাবুন তো আইসোলেশন ওয়ার্ডে বন্দি মায়ের কথা! জানালা থেকে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন, কোলের সন্তানকে কোলে নিয়ে ওই দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর অসহায় স্বামী। অবুঝ শিশুটি তার ‘অস্পৃশ্য’ মায়ের স্পর্শের জন্য অঝোরে কাঁদছে।আর মায়ের কান্না আইসোলেশন ওয়ার্ডের ভেতরেই পাথর হয়ে তাঁর ললাটলিখনকেই যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে।

কতো, কতো, এমন কতো টুকরো টুকরো যন্ত্রণা-চিত্রের কোলাজ আসলে মানব সভ্যতার ললাটলিখনকেই স্পষ্ট করে তুলছে।

এ শুধু আমার বাড়ি, আমার পাড়া, আমার শহর, আমার গ্রামের ছবি নয়, এই মারণ-ক্যানভাসে মৃত্যুর মিছিল পুরো ধরিত্রীর। বা বলা ভালো, দর্পিত দাম্ভিক সভ্যতার।

তা হলে কি ধ্বংসের শেষদিনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা? এটাই কি কয়ামত? Doomsday? এক অজানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস পুরো মানুষ জাতিকেই চিরতরে বিনাশ করে দেবে? মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে প্রাণের স্পন্দন-ধন্য এই গোটা গ্রহটি?

মানুষের মধ্যে প্রকৃতিই হয়তো তৈরি করে দেবে এন্টিবডি। লক্ষ লাশের কাতার শেষে মানুষ একদিন ঠিক করোনা বধের আয়ুধ নির্মাণ করবে।

শুধু তাই নয়, দুর্বহ জনবিচ্ছিন্ন সময়কেও নিজের মতো করে অর্থবহ করে কী সুন্দর নন্দিতভাবে মানুষ তার উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। এই অবিশ্বাস্য রোদন ভরা বসন্তে বিহুকুয়রীরা লকডাউন বন্দি, বোবা হয়ে পড়ে আছে ঢোল পেঁপা, কিন্তু গামোছা দিয়ে মাস্ক তৈরি করে মানুষ আসলে করোনা রাক্ষুসিকে এই বার্তাই দিয়ে রাখছে যে তার সংস্কৃতিও বিপর্যয়ে অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। ফেসবুকে একের পর এক লাইভে গান থেকে শুরু করে নাটক, আবৃত্তি..,.মানুষ আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে যে-কোনও বিপর্যয়ের মধ্যেও সে পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিতে পারে। এবং নিতে পারে বলেই মানুষ জীবশ্রেষ্ঠ। ধ্বংসভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো সৃষ্টির আকাশে ওড়ার মন্ত্রই মানুষকে মানুষ করে রেখেছে। করোনা আরও একবার সেই প্রত্যয়ই সুনিশ্চিত করে যাবে। কারণ এই লকডাউন-স্তব্ধ সময় মানুষকে আখেরে এই পাঠই দিয়ে যাবে যে, মানুষ আসলেই বাঁচে মানুষের জন্য। শিখিয়ে দিয়ে যাবে, জীবনই অমোঘ সত্য। শিখিয়ে দিয়ে যাবে, ধর্মের চেয়েও বড় জীবন।

এই করোনা স্তব্ধ সময়ে মানুষ সভ্যতার যাবতীয় সম্মিলিত পাপকে পুড়িয়ে ফের সভ্যতারই স্বর্ণমিনার নির্মাণ করবে। গণচিতার দাউ দাউ শ্মশান শেষে যে নতুন বছর এলো, তা এই বার্তাই আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেবে যে, জীবনই সব। জীবনের কাছে ইতিহাস মিথ্যে, ভূগোল মিথ্যে, ধর্ম মিথ্যে। একমাত্র সত্য জীবন।

Comments are closed.