Also read in

রাজ-আজ্ঞার নামে স্বৈরাচারিতা! দুর্গাপুজোর বিধিনিষেধ নিয়ে কি বলছেন জনগণ

লকডাউন চলাকালীন কাছাড় জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন নীতি হোক বা পরবর্তীতে অতিরিক্ত লকডাউন, প্রায় সবগুলোই সরাসরি গরিব-বিরোধী ছিল। পুজোর নিয়ম নীতি বানানোর ক্ষেত্রে এই ধারাই বজায় রেখেছেন জেলাশাসক কীর্তি জল্লি। পুজোর মাত্র কুড়ি দিন আগে বলা হলো পাঁচ ফুটের মূর্তি বানাতে হবে, সকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পুজো মন্ডপ খোলা থাকবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ, এমনকি ছোটখাট চা এবং চাটওয়ালাদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত মানুষ। আর্থিক দিক বাদ দিলে, বাঙালি সংস্কৃতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দুর্গাপূজাকে খাটো করার মত এই নির্দেশ। তাও এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে যখন কেন্দ্র সরকার আনলক পঞ্চম স্তরের একের পর এক বিধি নিষেধ তুলে দিচ্ছেন। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ৭ কোটির বেশি ভোটদাতা থাকা রাজ্য বিহারে দফায় দফায় নির্বাচন আয়োজন করছে।

রাজ্যের মুখ্যসচিব কুমার সঞ্জয় কৃষ্ণা জানিয়েছেন, সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, সংশ্লিষ্ট জেলাশাসককে সিদ্ধান্তটি নিতে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা রাজ্যের ৩৩টি জেলা প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছি। কাছাড় জেলায় যে নির্দেশ জারি করা হয়েছে সেটা জেলাশাসক ঠিক করেছেন, রাজ্য সরকারের এব্যাপারে কোনো মতামত ছিল না।”

শুক্রবার বিকেলে জেলা শাসকের নির্দেশটি জনসমক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নানান প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। একাংশ নির্দেশের সমর্থন করলেও আংশিক সমালোচনা করেছেন, বহুলাংশ এই নির্দেশটি বদলে নতুন নির্দেশ গঠন করার দাবি তুলছেন। দেখা যাক কে কি বলছেন:

 

Dilip Paul

দিলীপ কুমার পাল,বিধায়ক, শিলচর

এই সময়ে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক রীতিতে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠান হবে না, এমনটাই কথা ছিল। প্রশাসন যে নিয়ম-নীতি গঠন করেছেন সেটা সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে পুজোর কিছুদিন আগে মূর্তি ছোট করার নির্দেশ আমার পছন্দ হয়নি। পাশাপাশি আমি এও বলবো, পুজো করতে হলে মণ্ডপে যেতে হবে এর কোনও মানে হয়না। তাই জেলার প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে আমার অনুরোধ আপনারা অন্তত এই বছর নিয়ম মেনেই পুজো পালন করুন।

 

 

Sushmita Dev

সুস্মিতা দেব, প্রাক্তন সাংসদ

যখন শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ উদ্বোধন করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে শিলচরে এলেন, সেই অনুষ্ঠানে হাজারের উপর মানুষ যোগ দিয়েছেন। অথচ তার এক মাস পরে যে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে সে ক্ষেত্রে ১০ জনের বেশি লোক জড়ো হতে পারবেন না, এটা হাস্যকর। জেলাশাসক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে জমায়েত আটকাতে পারেন না, আর বাঙালির সবথেকে প্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা বন্ধের নির্দেশ দেন, এতে তার কাজ কর্মের ওপর সন্দেহ জাগে। আদৌ তিনি জনগণের চিন্তা করেন না শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধিদের সুবিধার্থেই সিদ্ধান্ত নেন।

.

Tamal Banik

তমালকান্তি বণিক, অম্বিকাপুর দূর্গা পূজা কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন পুরপতি

আমরা পুজো করব কিনা এটা বলে দেওয়ার তারা কেউ নন। সম্প্রতি দেখা গেছে গমকে আবশ্যক সামগ্রিক তালিকায় রাখা হয়েছে কিন্তু চালকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর থেকে ধারণা করা যায় আমরা আগামীতে কোন রাস্তায় এগোচ্ছি। বাঙালির দুর্গাপূজা এখন আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রয়োজনীয় উৎসব নয়, তাই এধরনের উদ্ভট নিয়ম গঠন করা হয়েছে। আমরা এবার অম্বিকাপুর দুর্গাপূজার ১০১ বছর পালন করব। পুজো আমরা করবই, প্রয়োজনে কারো বাড়ির ভেতর পুজো হবে, কিন্তু এই নির্দেশ মানবো না।

অসীম দত্ত, আনন্দ পরিষদ দুর্গা পূজা কমিটির সদস্য

এটাতো রাজ-আজ্ঞা, আমরা সাধারন মানুষ, তাদের কথা মেনে চলতে হয়, না হলে শাস্তির ভয় আছে। যদি পুজো করতে দেওয়া না হয় আমরা নিজেদের বাড়িতে হলেও মায়ের পূজো সেরে নেব। রাজার দেশে প্রজারা কিভাবে তার বিরুদ্ধে গিয়ে পুজো করবে? মা দুর্গা প্রতিবছর আসেন এবারও আসবেন, রাজার শাস্তির ভয়ে আমরা মায়ের অবহেলা করবো না।

সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের সরকার এধরনের একটি নির্দেশ জারি করেছিল, শাসকদলের রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত একে বাঙালি ‘বিরোধী আখ্যা’ দিয়েছিলেন। অথচ ১৫ লক্ষ বাঙালি থাকা এক জেলায় এ ধরনের নির্দেশ জারি হচ্ছে। এতে শাসকদলের অনেকেই মন্তব্য করতে নারাজ। আমরা উপত্যকার একমাত্র মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্যর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি তিনি উত্তর দেননি। দলের বরিষ্ঠ নেতা কবীন্দ্র পুরকায়স্থ এব্যাপারে মন্তব্য করবেন না বলে দিয়েছেন। তবে শুধু জনপ্রতিনিধি নয় আমরা সাধারণ মানুষের মন্তব্য নিতে আগ্রহী। আগামীতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা বা চাট বিক্রি করা ব্যক্তি থেকে শুরু করে জেলার সংস্কৃতি মহল, প্রত্যেকের মন্তব্য নেওয়া হবে এবং সেটা প্রকাশ করা হবে। হয়তো প্রশাসন স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠানকে ব্রাত্য করে রাখবে। কিন্তু জনগণের আওয়াজ আমরা তাদের কানে পৌঁছে দেওয়ার নিশ্চয়ই দায়িত্ব নিতে পারি।

Subhasish Choudhury

শুভাশিস চৌধুরী, ছাত্রনেতা এবং হিন্দু সংহতির সদস্য

যখন নেতারা পরিদর্শন করেন সেসময় প্রটোকল বলে কিছু থাকেনা, অথচ বাঙালি হিন্দুর সবথেকে প্রয়োজনীয় উৎসবের ক্ষেত্রে যা নয় তাই বিধিনিষেধ। পুজো মণ্ডপে জনসমাগম কম করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে এর নামে অঞ্জলি বন্ধ করে দেওয়া, মূর্তির সাইজ ছোট করে দেওয়া, বিসর্জনে পাঁচজনকে পাঠানো, ছোটখাটো চা স্টল ইত্যাদি পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া এমনটা হওয়ার কথা নয়। মন্ডপ বানিয়ে পুজো করা যাবে, রাত দশটার পর কেউ বের হতে পারবেন না, কি কারণে এসব নিয়ম বানানো হয়েছে এটা স্পষ্ট নয়।

উপত্যকার সাংস্কৃতিক নিজস্বতার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজো। এই নির্দেশের মাধ্যমে জেলাশাসক আমাদের সাংস্কৃতিক মেরুদন্ডে আঘাত করেছেন। পুজোর কুড়ি দিন আগে মূর্তি ছোট করার মত নির্দেশ অত্যন্ত নিন্দনীয়। যেখানে প্রায় প্রত্যেক মূর্তি নির্মাতা কাঠামো তৈরি করে নিয়েছেন, এখন কি তারা সেগুলো ভাঙবেন এবং আবার মূর্তি গড়বেন?

করণজিৎ দেব, ছাত্রনেতা

ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট এর ৩৪ নং ধারার অধীনে কাছাড় জেলা প্রশাসন আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য এসওপি জারি করেছে । কাছাড় জেলার জেলাশাসক তথা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির চেয়ারপারসন আইএএস কীর্তি জল্লি স্বাক্ষরিত এই এসওপি তে দুর্গাপূজা উদযাপনের নিয়ম কানুন প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ জারি করা হয়।

যেখানে প্রথমে উল্লেখ্য যে শুধুমাত্র স্থায়ী পূজা মন্ডপগুলিতেই দুর্গাপূজা আয়োজনের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে এবং যে সকল পুজো কমিটি অস্থায়ী মন্ডপ তৈরি করে দুর্গাপূজা আয়োজন করে তাদের অনুমতি প্রদান করা হয়নি। কিন্তু সধারণভাবে দেখতে গেলে বেশিরভাগ পুজো কমিটিই অস্থায়ী মন্ডপ গড়ে দুর্গাপুজো আয়োজন করে । শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে হাতেগোনা কয়েকটি স্থায়ী মন্ডপ ছেড়ে দিলে দেখতে গেলে এ বছর দুর্গা পূজা আয়োজন করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাছাড় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন পূজা কমিটির বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে পুজো কমিটিগুলির সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করার এবং দ্বিচক্রযানের চলাচলের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার ওপর কার্যতঃ সিলমোহর পড়ল এই এসওপি তে। যদিও সাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে করোনা সংক্রমণের যোগসাজশ বোধগম্য হয়নি। আবার চার চাকার গাড়ি বা অটোরিক্সা চলাচল করলেও দ্বিচক্রযানের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞায় এর প্রস্তাবকারীদের যুক্তির উপর জনমানসে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ওই বৈঠকেই পুজো কমিটি এবং প্রশাসনের আলোচনা সাপেক্ষে পুষ্পাঞ্জলী প্রদানের জন্য উপস্থিতি কম করা এবং প্রসাদ বিতরণের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

প্রকাশিত এসওপি মতে রাত্র ১০ ঘটিকার পর পূজা মন্ডপ বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে ১০ ঘটিকার পর মন্ডপ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও কারো রাস্তায় অথবা অন্য কোন জায়গায় ঘোরাঘুরির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি, অথবা কার্ফু জারি করা হয়নি ।

কাছাড় জেলা প্রশাসন করোনা মহামারী সংক্রমণ রুখতে এই এসওপি জারি করেছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে স্থায়ী পূজামণ্ডপগুলোতে যেরূপ সাবধানতা অবলম্বন করে দুর্গাপূজা আয়োজন করা হবে তদ্রূপ ভাবেই অস্থায়ী পুজো মণ্ডপেও সাবধানতা এবং সতর্কতার সঙ্গে কোভিড বিধিনিষেধ মেনে হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসব দুর্গাপূজা আয়োজন করার অনুমতি প্রদান করা হোক।

 

Comments are closed.