Also read in

আলোড়িত স্বদেশই আগামী আলোর উৎস

বর্তমান ভারতে জোর দড়ি টানাটানির খেলা চলছে। রাজনীতিতে এই খেলার নাম মেরুকরণ বা পোলারাইজেশন্ । তবে জিনিসটি যে নতুন কিছু, এমন নয়। ধর্ম এই দেশে চিরদিন নিয়ামকের ভূমিকায়। স্বাধীনতার পর থেকে যারা নিজেদের ( তথাকথিত) ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করেন তাদেরও নিরপেক্ষতা দেখাবার প্রমাণ সেই  ধর্মতেই বাঁধা।তাই নমাজ,হিজাব, ইফতার, ভাতা ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ভোটের আগে আরও প্রয়োজন একটু বেশি । ইদানীং অবশ্য ঘুরিয়ে বলার পালা শেষ। কোন ঢাকাচাপা নেই,সরাসরি এবং মুখোমুখি আক্রমন। দেশের প্রধানমন্ত্রী খোলাখুলি ধর্ম, পোষাক একাকার করেন। দড়ির দুটো প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রচুর লোকের হল্লাবোল চলছে। কেউ কারো কথা শোনে না, শোনার ইচ্ছে নেই। কেউ কারো কথা বোঝে না, বোঝার ইচ্ছেও নেই।  মাঝখান থেকে কারফিউ, গুলি, লাঠি, বারুদে কিছু লোক মরে সাফ, হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির বিনাশ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারনেট বন্ধ। সামাজিক মাধ্যমে আজকাল এই প্রসঙ্গের পোষ্টগুলো পুরোটা না পড়লেও চলে। কে বা কোন গ্রুপ থেকে এসেছে একবার আলতো চোখে দেখলেই হল। মোটামুটি বোঝাই যায় নির্যাস কি হবে বক্তব্যের। তবে যা হয়েছে বা হচ্ছে তা আকাশ থেকে পড়ার কিছু নয়। এই দেশে, সব দেশে বারবার হয়ে আসছে। জাতিরাষ্ট্র, গণতন্ত্র, ভোট, ভোটার ইত্যাদি যেভাবে আছে বা যতদিন থাকবে, যতদিন এইভাবে ব্যবহৃত হবে  রক্তপাতের, হিংসার, প্রতিহিংসার বিরোধগুলো থাকবেই। এর কারণতো অনেকগুলোই থাকার কথা। আছেও। তবে যে কারণটি মোক্ষম কারণগুলোর একটি তা বলা হয়ে গেছে অনেক আগেই…All men are equal, but some are more equal than others.বিদ্যা, বুদ্ধি, চর্চা, যাপনে বাদবাকি থেকে একটু বেশি সমান থেকে সবাই সমান হওয়াটা কোনোদিন যদি সম্ভব হয়, মানব ইতিহাস অন্যরকম হবে নিশ্চয়ই। তাই যতদিন না মানব সভ্যতা বিকল্প কিছু ভেবে বের করতে পারছে কাজ চালাতে হবে এই প্রচুর ব্যবহৃত এবং বহুলাংশে ব্যর্থ রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিয়েই।

আজকের ভারতের এই টাগ অফ ওয়ার’টা নাগরিকত্ব নিয়ে। দেশের মানুষকে প্রমাণ করতে হবে তাও  কাগজপত্র দিয়ে তারা এই দেশে আছেন কোন একটি নির্দিষ্ট তারিখ থেকে। যেহেতু মানবপ্রবৃত্তি প্রব্রজনকারী আর মানবসভ্যতাও সুপ্রাচীন তাই দেশ কাল তারিখের নিরিখে একটি  ভূখন্ডে কে কতদিন ধরে আছেন কাগজ পত্রে তার হিসেব রাখা মৌলিক মানবপ্রবৃত্তি যা আবার প্রাকৃতিকও তাকে প্রশ্ন করা ছাড়া আর কি? তবে যেহেতু জাতিরাষ্ট্র চালাতে গেলে কিছু পদ্ধতির ব্যবহার ছাড়া গতি নেই তাই এই তারিখ, নম্বর, কাগজ, নানা রংগের কার্ড, লম্বা লম্বা ভিসার খেলাটা নতুন কিছু নয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেশই করে। নইলে কিভাবে সব দেশেই কারাগার থাকতে হয়? পুলিশ, মিলিটারি, গোয়েন্দা সংস্থা থাকতে হয়?  অভিবাসী, অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী নতুন শব্দ না হলেও আজকের পৃথিবী এদের সমস্যা বলেই ভাবে। তাই আমারিকা মেক্সিকানদের আটকাতে পাঁচিল তোলে, অষ্ট্রেলিয়া বানায় ডিটেনশন ক্যাম্প। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসটা বড় জটিল। কারা যে ‘ভিতরের লোক’ কারা যে ‘বাইরের’ হাজার হাজার বছর পুরোনো এই ভূখন্ডে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে রেশম সুতোর মত জড়িয়ে যায় অনেক হিসেব নিকেশ। এত সূদুরে না গিয়ে সিপাহী বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, সিলেটগণভোট, বাংলাদেশের সৃষ্টি এই কয়টির হিসেব মিলিয়েই  কে ভারতীয় আর কে নয় তার ফয়সলা সোজা নয় মোটেও। ফয়সলা গুলোর উপর যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোট বাক্স, আঞ্চলিকতাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদের অঙ্ক মেলানো হবে তখন সহজও কঠিন হতে কতক্ষণ? সারা ভারতে চালুর আগে আসামে এনআরসির পায়লট প্রজেক্ট করা হল। এই প্রজেক্ট ভয় ধরিয়েছে পুরো দেশকে। একশর অর্ধেকের বেশি মৃত্যু, ডি তকমা, ক্যাম্প নামক আটকস্থান ভয় জাগানিয়া তো বটেই। তার উপর স্বরাট্রমন্ত্রীর ‘প্রথমে বিল তারপর এনআরসির’ হুংকারে মানুষ সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছেন।  এই পথে নামা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক বা স্বার্থহীন নয় অনেকের ক্ষেত্রেই। নেতা,নেত্রীরা এই সুযোগ পেয়ে ছাড়বেন কেন? হাতের লক্ষ্মী যে! আন্দোলনকারী অনেকেই জানেন না কেন পথে নেমেছেন তারা। এই তালিকায় অনেক উচ্চশিক্ষিত তারকা সেলিব্রিটিও আছেন। আছেন অশিক্ষিত সাধারন মানুষ যারা অকপটে স্বীকার করেছেন তারা ভাড়া করা, ভিড় বাড়াতে এসেছেন। তবে এর বাইরেও আছে কিছু দেখার। দিল্লিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা হঠাৎ করে প্রিয়ংকা গান্ধির আগমন এবং প্রতিবাদে মুখর হয়ে আন্দোলন হাইজ্যাক করার প্রবণতাকে ঠিক ধরে ফেলেছিলেন। তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তারা অরাজনৈতিক  অবস্থানে থেকেই প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। তাই স্বার্থযুক্ত ‘প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ’ অথবা সম্পূর্ণ গণস্বার্থে বা নন পার্টিশিয়ান হয়ে ‘সংবিধান রক্ষার্থে প্রতিবাদ’ যাই হোক না কেন, দেশের মানুষ পরিষ্কার ভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন।তারা পথে নামছেন, প্রতিবাদ করছেন, মানুষের ভোটে জিতে আসা সরকারের সমালোচনা করছেন। ভারত সরকার এই সত্যকে কোনোভাবেই নাকচ করতে পারবে না। প্রাণপণে করতে চাইলেও না।

আজকের দিনে তাই একটি মৌলিক প্রশ্নটির মুখোমুখি আমরা। সংখ্যাধিক্যের মতামত ( public opinion)  আর জনগনের ইচ্ছা ( public will) কি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ? রুশো জনগনের ইচ্ছা বা সেন্টিমেন্টকে বলেছেন ‘ general will’. তিনি বলেছেন, জেনারেল উইল বা সেন্টিমেন্ট যে সংখ্যাধিক্যের মতামত হবেই তার কোন কারণ নেই। স্বরং সংখ্যাধিক্যের সুযোগ নিয়ে জনগনের সেন্টিমেন্টের  উপর যদি কিছু চাপানো হয় তা গণতন্ত্র নয়। এবার যে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে তা হল একটি দেশ তার জনগনের উইল’ বুঝবে কি করে।আধুনিক গনতন্ত্রে নানা দেশ নানা ভাবে তা বোঝার চেষ্টা করে।সুইজারল্যান্ডে প্রতিটি আইন প্রণয়নের আগে গণভোট করিয়ে নেওয়া হয়। ভারতের মত বিশাল এবং দুর্নীতির দেশে প্রতিটি আইন  গণভোটের মাধ্যমে প্রণয়ন করা কঠিন, প্রায় অবান্তর প্রস্তাব। এক সিলেটগণভোটের ক্ষত কত পরিবার যে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে!

তাই আইন প্রনয়নের আগের ধাপটা ভারতের মত দেশে খুব জরুরি। তা হওয়াটা জনগনের অধিকার। করানোটা সরকারের দায়িত্ব। নাগরিকত্বের মত একটি অতিসংবেদনশীল প্রস্তাব আইনে পরিণত হবার আগে তা নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি  স্তরে প্রচুর আলোচনা,বিতর্ক, মতামত দেওয়া নেওয়া হবে, গণতন্ত্রে এই নিয়ম। ২০১৬ সালে ক্যাব এই উদ্দেশ্যেই যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে সঁপে দেয়া হয়। সারা দেশ থেকে মতামত সংগ্রহ করা হয়। কমিটি দেশ সফরও করে। প্রথমত , ওই পর্যন্ত পদক্ষেপ হয়তো যথেষ্ট ছিলো না । সরকারি বিতর্কের ব্যবস্থা করা, উৎসাহ দেওয়া হয়তো আরও দরকার ছিল ।এতে জনগনের বুঝতে সুবিধা হতো তারা কি পেতে বা হারাতে যাচ্ছেন। আইনজ্ঞরা অনুপুঙ্খ বিচার করবেন প্রস্তাবটির, দরকারে পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের মতামত নেবেন। ব্রিটেন, ফিনল্যান্ড, ইউরোপের নানা দেশে এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রনয়ন করা হয়। বর্তমান বিলের ক্ষেত্রে হয়তো তা যথেষ্ট পরিমাণে হতে পারেনি। ভেংকইয়া নাইডু এই নিয়ে মৃদু হলেও উদ্বেগ দেখিয়েছেন। একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে , উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে আইনটির সার বস্তুকে ভুল ব্যাখ্যায় নাগরিককে ব্যতিবস্ত করে তোলার যে রাজনীতি-ব্যবসা চলছে সেটাও এতখানি সম্ভবপর হতো না ।

তাই আজকে দেশে যা হচ্ছে বহুলাংশেই তা ধোঁয়াশা ধারনা থেকে। যারা সমর্থন করছেন বা বিরুদ্ধে বলছেন, এমন কি যারা সরকারে আছেন তাদের অনেকেই বিল, এনআরসি, এনপিআর নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ধোঁয়াশাটা সরকারিভাবে জারি রাখা হচ্ছে,  নাকি চিন্তা বা কৌশলের প্রয়োগজনিত ব্যর্থতার পরিনাম যে যার মত করেই ভাবছেন। কিন্তু একধরনের আতঙ্ক উদ্বেগ মানুষকে গ্রাস করেছে তা আজকের দিনের চরম সত্য। সরকার তাই ভাবতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন আপাতত এনআরসি সারা দেশে চালু করার কোন প্ল্যান তাদের নেই। জনগনের মতকে মান দিয়ে এই পিছিয়ে আসাটা দারুন ইঙ্গিতবাহী। worst of time এর মাঝেই best of time লুকিয়ে থাকে, বা তার উল্টোটা। আজকের ভারতের এই দোলাচল কিন্তু দেশের শক্ত গনতন্ত্রের ভিত প্রমাণিত করে। Roger Nash Baldwin, যিনি সারা জীবন মানবাধিকার রক্ষায় লড়াই করে গেছেন তার একটি বিখ্যাত উক্তির উল্লেখ করছি…”So long as we have enough people in this country willing to fight for their rights, we’ll be called a democracy.” মহান অক্টোভিয়ান সিজারের মহান  রোমান সাম্রাজ্য পতনের ইতিহাসে তার সেই সময়কার চালু করা জনগননার পদ্ধতি একটি বড় ভূমিকা নিয়েছিল। সাধারন মানুষ বিকল্প খুঁজতে খুব সময় নেন না। বিকল্পের বিকল্প খোঁজা বা দরকারে তৈরি করে ফেলা গণতন্ত্রে বহুবার হয়েছে।

তবে  আশংকা অন্য। ভারতে কিন্তু পোলের দুইপাশের মানুষ ছাড়াও বিশাল আরোও একটি অংশ রয়েছেন যারা  ডি-ক্যাম্পে দীপক দেবনাথ বা লালসান বিবির আত্মহত্যায় সমান দু:খ অনুভব করেন। চেষ্টা করেও এরা মুসলমান বিদ্বেষী হতে পারবেন না, অথবা অন্ধ চাপা মোল্লা। আবার দেশভাগ তাদের কাছে অলীক, দূর থেকে শোনা, সিনেমা দেখে আহা উহু করার ব্যাপার নয়।দেশভাগ, তার যন্ত্রনা, রূঢ় বাস্তব তাদের কাছে। যার রেশ সত্তর বছরে মিলিয়ে যায় নি। তারা বোঝেন  মিলখা সিংএর দেশভাগের ক্ষত আর পূর্ব পাকিস্তানের কোন এক অখ্যাত হিন্দু পল্লী উচ্ছেদের কাহিনী দুটোর প্রচার প্রসার সমান না হলেও দু:খ অপমান ক্ষুধা দুটোতেই সমান। সুযোগ পেলেই পাব্লিককে কটাক্ষ করে হাততালি দিয়ে তারা বলেন না, “বেশ হয়েছে! ভোট দিয়েছ এবার বোঝ।” যেন তারা এই হাততালি দেবার সুযোগটার জন্যই ওঁতপেতে ছিলেন। তারা অর্থনৈতিক কারণে, উন্নত জীবনমানের সন্ধানে দেশছাড়া আর সম্মান ও  প্রাণবাঁচাতে সাতপুরুষের ভিটে ছাড়ার মধ্যে যে অন্তর রয়েছে তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। ছাত্রদের রক্ত যেমন তারা দেখতে চান না তেমনি পুলিশেরও। দাঁতে দাঁত ঘসে তারা ছাত্রপেটানোর সমর্থনে একশটা যুক্তি তুলে ধরেন না। দেশের সম্পত্তি যা তাদের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি, ধ্বংস হলে তাদের গায়ে লাগে। এরা আশ্চর্য হয়ে দেখেন তিন হাজার কোটি টাকা শিক্ষা বাজেট থেকে কেটে নেওয়া হল দেশে টু শব্দটি হল না। খাদ্য, পরিবেশ, শিক্ষা, নিয়োগ সব ক্ষেত্রেই তো প্রচুর শঙ্কা,প্রচুর গোঁজামিল। কিন্তু , সাধের স্বদেশটি ধর্ম ছাড়া কিচ্ছুটি দেখে না। দেখেন না ধর্ম রাষ্ট্র বাদী ও
ধর্ম নিরপেক্ষবাদী পোলের দুটো দিকের কেউই ।

রাজনৈতিক মাতলামোর এই ডামাডোলের মধ্যে   স্বচ্ছ ,নিরপেক্ষ চিন্তার মনমগজওয়ালা মানুষগুলোকেই কিন্তু সবচাইতে বেশি পর্যুদস্ত, ধ্বস্ত হতে হচ্ছে। দুই পোল থেকেই এঁদের ওপর অপরাপর আক্রমণ অপমান করা হচ্ছে। তাদের একটাই প্রধান অপরাধ ,তাঁরা কোনো পোলের সুরে সুর মেলাচ্ছেন না।

এদের মধ্যেকার একাংশ মানুষ তিতিবিরক্ত, দিকভ্রান্ত হয়ে মারাত্মক পোলারাইজেশনের কোন এক পোল ধরে ঝুলে পড়লে কেউ যেন বিস্ময় জ্ঞাপন না করেন। কারণ, সকল পক্ষ মিলে এদের দেয়ালে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে। এই একাংশও যদি আগামীতে গণতন্ত্র বিরোধিতাকে পাথেয় করে নেন , তবে তার জন্য দায়ী থাকবে রাজনীতি ব্যবসার ওই দুই পোল।

এই নিবন্ধটি লিখেছেন শিক্ষিকা পাপড়ি ভট্টাচার্য। উনার এই অবদানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

Comments are closed.