Also read in

"পোর্টাল আসার পর প্রিন্ট মিডিয়ার অস্তিত্ব সংকটের মুখে:" অরিজিৎ আদিত্য

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভূমিকার প্রয়োজন হয় না, নিজের নামই সেই দায়িত্ব বহন করে। এরকমই একটি নাম অরিজিৎ আদিত্য। কখনো বা প্রতিবাদে সম্পাদকের কলম ঝলসে উঠেছে, কখনো বা তাঁর নাটকের সংলাপে দর্শকরা নড়েচড়ে বসেছেন, কখনো বা দর্শকের হাততালির জোয়ার তার প্রশংসনীয় নাট্যশৈলীর সাক্ষ্য বহন করেছে, কখনো বা লেখকের কলম অশ্রুসিক্ত হয়েছে কারোর বুকফাটা কান্নায়, কখনো বা সতীর্থ কোনও লেখকের গায়ে বিরোধী কোন শক্তির আঁচড় লাগার আগেই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন সবার প্রথমে- সবমিলিয়েই অরিজিৎ আদিত্য। আট বছর যুগশঙ্খের সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পর এই পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন হঠাৎ করেই। বরাক উপত্যকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটা কেন নিলেন? সম্পাদক হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে? তার পরবর্তী পরিকল্পনা কি? নাট্যকার, লেখক কিংবা সাংবাদিক, আগামী দিনগুলোতে কে প্রাধান্য পাবেন? কোন ভূমিকায় দেখা যাবে তাকে? এগুলো সহ আরো অনেক কিছু নিয়েই আজকের কথোপকথন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বরাক বুলেটিনের স্বতন্ত্র পরিচালক তথা সাংবাদিক অনির্বাণ রায় চৌধুরী।

কথোপকথনের সম্পাদিত অংশ

আপনার এই যে সম্পাদক পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত, সেটা কি খুব ভেবেচিন্তে নেওয়া, না হঠাৎ করেই নিলেন সিদ্ধান্তটা?

বাংলায় একটা কথা আছে, ‘পদ্মপাতায় জল’! সাংবাদিকের চাকরিটাও ঠিক তাই! কখন কি হয় বলা যায়না।

তবে এটা ঠিক, বেশ কিছুদিন ধরেই এ সিদ্ধান্তটার দিকে এগোচ্ছিলাম।যুগশঙ্খের দফতরে আমি একটি ভাঙ্গা চেয়ারে বসতাম। সেই চেয়ারটা আবার এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করত। তাই অফিসে ঢুকে প্রথমেই হাক ছাড়তাম, ” কোথায় রে,আমার ভাঙ্গা চেয়ার টা কোথায়?”

এই কথাটার কিন্তু একটা গূঢ় অর্থ রয়েছে, অবশ্যই তা সাংকেতিক।

আমার আসলে চাকরি ছাড়ার একটা দীর্ঘস্থায়ী রোগ রয়েছে। সেন্টিনেলে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল। সেন্টিনেলের মালিকের খুব কাছের মানুষ ছিলাম আমি।উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা কথার জন্যই ন বছরের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। যুগশঙ্খেও তার আগে ২০০৮ এ আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। যদিও তখন আমি ক্যাসুয়াল স্টাফ ছিলাম। আমি একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, একজন লোক ভালো লেখতে পারে, কিন্তু এটার মানে এই নয় যে সে একজন ভালো সাংবাদিকও হবে। সাংবাদিক হওয়ার জন্য দুটো জিনিস থাকা খুবই জরুরি। এক হচ্ছে আত্মসম্মানবোধ, আর হচ্ছে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক কিছুদিন ধরেই এই দুটোর অভাব বোধ করছিলাম।তবে এই নয় যে, আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখান থেকে আমাকে কোন লেখার বিষয়ে বাধা দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যুগশঙ্খের কলকাতা সংস্করণেও সম্পাদক হিসেবে আমার নামটা রয়েছে। শিলচরে না হলেও ওই জায়গাটায় কিন্তু আমি চাপটা অনুভব করেছি। বেশ কিছুদিন আগে বাঙালি তপশিলি জাতি অধ্যুষিত আসামের দুড়ুং গ্রামের দুটি পরিবারের হৃদয়বিদারক কাহিনী আমাকে প্রচন্ড রকম ভাবে নাড়া দিয়েছিল।তাদের বাবা রেঙ্গুনে নেতাজির সঙ্গে যুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু এনআরসিতে তাদের নাম ওঠেনি। আমি ওদের নিয়ে একটি স্টোরি করেছিলাম। গুয়াহাটি এবং শিলচর সংস্করণে স্টোরিটি বেরিয়েছে এবং এতে কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু কলকাতা সংস্করণে যখন বেরিয়েছে তখনই এ নিয়ে আমাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।আর এই চাপের মুখোমুখি হয়ে আমাদের মাথা নত করতে হয়েছে। এসব থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম, এগুলো মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে। এভাবেই ধীরে ধীরে সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়েছি।

তবে যুগশঙ্খ কর্তৃপক্ষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করেছেন, অনেক প্রশ্রয় পেয়েছি তাদের কাছ থেকে।

নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ বনাম মালিকপক্ষের রাজনৈতিক মতাদর্শ বনাম বিজ্ঞাপনের আয়, এই তিনের অদৃশ্য টানাপোড়নে সম্পাদকের দায়িত্ব কতটা?

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যখন আমি লিখেছি সেটি ছিল ‘এন্টি এসটাবলিসম্যান্ট’। আমার কাছে কিছু তথ্যাদি ছিল, বুঝতে পারছিলাম কিছু অনৈতিক কাজ চলছে। তাই এটা নিয়ে আমি লিখেছিলাম। এখানে আমি দুটো ব্যাপার দেখেছি, আমাদের যে পোস্ট এডিটোরিয়াল যায় সেটাতে আমি চেয়েছিলাম, বিভিন্ন ধরনের ভিউ যাক। কিন্তু একসময় ব্যাপারটা আমার জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। উল্টোমুখী ভিউ লেখার মানুষের অভাব হয়ে যায়। এখানে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, আসামের কোনও বাংলা পত্রিকায় এন্টি গভর্ণমেন্ট বা গভমেন্টের পলিসির বিরুদ্ধে কোন পোস্ট এডিটোরিয়াল বের হয়না। এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে হয়, আমার ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক বন্ধু একটা লেখা লিখেছিলেন। তার লেখাটা ডি-মনিটাইজেশন’র সময় আমরা প্রথম পাতায় ছেপেছিলাম। কিন্তু তারপর সেই অধ্যাপকের প্রায় চাকরি যাবার উপক্রম। অনেক মুশকিলে পড়তে হয়েছে তাকে। হয়তোবা এই বার্তাটা পৌঁছে গেছে অন্যান্য লেখকদের মধ্যে। তাই তারা এ ধরনের লেখা লিখতে উৎসাহী নন। কারণ তারা হয়তো মনে করছেন, এতে তাদের বিপদ হতে পারে। তাই একদিকে যেমন অন্য ধরনের সরকারবিরোধী লেখা ছাপা হতো না, তেমনি প্রকাশের জন্য অন্য ধরনের লেখাগুলো আমরা পেতামও না।

পাঠকরা কি এতসব বুঝবে? তারা হয়ত ভাববে সংবাদ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের লেখা ছাপছে না। আর আজকাল তো ‘বিকাও মিডিয়া’ টাইপের কথা খুব শোনা যায়। এই ব্যাপার গুলো সম্পাদকের উপর কতটা প্রভাব ফেলে কিংবা সম্পাদকের উপর কতটা দায়িত্ব বর্তায়?

কিছুদিন আগে কোন একটা ন্যাশনাল চ্যানেলে গানের রিয়েলিটি শোতে আসামের একটি মুসলিম মেয়ে খুব ভালো গান করছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অনামী এক মুসলিম সংগঠন ফতোয়া জারি করে। তখন অনেক হিন্দু লেখকরা এর বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু ফেসবুকে এক মুসলিম যুবক এর বিরুদ্ধে খুব সুন্দর করে একটা লেখা লিখেছিল। আমরা সেই লেখাটি পড়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তার লেখা আমাদের পত্রিকায় ছাপানো হয়। আসলে আমি বৈচিত্র্যময় লেখা প্রকাশের অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। না পারার কারণ হয়তো আমার প্রতিষ্ঠানে সেরকম পরিবেশ ছিল না।

আর সেরকম লেখাও পাইনি। তবে এটা ঠিক, এসবে সম্পাদকের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। প্রচণ্ড গালাগালি শুনতে হয়।আর যুগশঙ্খ বোধহয় একমাত্র সংবাদপত্র যেখানে সম্পাদকের ফোন নাম্বার দেওয়া থাকে কাগজে। নিঃসন্দেহে কর্তৃপক্ষের এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। আর তার জন্য প্রচুর ফোন আসতো আমার কাছে। বেশিরভাগটাই খুব গালাগাল থাকতো। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের সময় ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে যে স্টোরি ছাপা হয়েছিল, সে নিয়ে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। একইভাবে ২০১৬ সালে মোদির নির্বাচনী প্রচারের সময় ডিটেনশন ক্যাম্পে একজনের মৃত্যু ঘিরে একটা স্টোরি করেছিলাম, সেটা নিয়েও কথা শুনতে হয়েছে।

সংবাদ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিভাগ, রাজস্ব কিংবা ব্যবসা কিভাবে সম্পাদকীয় বিভাগকে প্রভাবিত করে?

এই ব্যাপারটা সবাই জানেন যে মিডিয়ার জগতে সত্যিকারের সম্পাদক কে এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। বিজ্ঞাপন যারা বিক্রি করছে তারাই বোধ হয় সত্যিকারের সম্পাদক। আমার অভিজ্ঞতাও বলছে, বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে প্রচুর পরিমাণে চাপ আসে।

বর্তমানে প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। যুগশঙ্খের রেভিনিউ কিংবা সরকারি বিজ্ঞাপন অনেক কমে গেছে। কাজেই পত্রিকা হাউসগুলো খুবই চাপের মুখে রয়েছে। কর্মী ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটা আমরা কিছুতেই মানতে পারিনা। কিন্তু কখনো কখনো কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন ছাঁটাই করতে। প্রিন্ট মিডিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর সঙ্গে টেকনোলজির ব্যাপারটাও জড়িত রয়েছে। এখন মানুষ খুব তাড়াতাড়ি মোবাইলের মাধ্যমে সব ধরনের খবর পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে পত্রিকার সার্কুলেশন এ এর প্রভাব পড়ছে। কাজেই সার্কুলেশন থেকে যে রেভিনিউ আসছে সেটাও প্রভাবিত হচ্ছে। সরকারের বিজ্ঞাপন কমছে। আগে যেমন সব বিভাগে টেন্ডার ডাকা হতো। এখন সবকিছু অনলাইনে হয়ে যায়। আগে আসাম রাইফেলস’র অনেক বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত। এখন সেগুলো প্রায় দেখাই যায়না। তাই মালিকপক্ষের উপরে খুবই চাপ রয়েছে। এর ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সম্পাদকের উপরও এসে চাপটা পড়ে। এটা তো এখন ওপেন সিক্রেট।

সাধারণ পাঠকের কাছে পক্ষপাতশূণ্য, কোনও ধরনের ফিল্টার না করে মতামত পৌঁছে দেওয়ার রাস্তাটা আপনার মতে কি?

আমিতো খুব আশাবাদী মানুষ।আমি এখনও বিশ্বাস করি, যদি কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে ‘ডাইভারস ওপিনিওন’ তুলে ধরি, তাহলে ভালো সংবাদপত্র হলে সেটা অবশ্যই চলবে। তখন সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলো বিজ্ঞাপন দিতেও বাধ্য হবে। কারণ তাদেরও তো মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজন রয়েছে। এটা আসলে দুই দিক দিয়ে একটি চাপের খেলা চলছে।

টেলিভিশন আসার পর সবাই বলেছিল যে প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যত নেই। কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া তারপরও টিকে ছিল। কিন্তু পোর্টাল আসার পর প্রিন্ট মিডিয়া অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে।এর ফলে প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদের ধারাকে পাল্টাতে হবে। কোনো ঘটনা ঘটলে পোর্টাল সে ঘটনার খবর টুকুই দিচ্ছে, কিন্তু সেটা দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। এখন প্রিন্ট মিডিয়ায় যদি পরের দিন শুধু সংবাদ টুকুই আসে, তাহলে কিন্তু কেউ আর পড়বে না। তাই এখানে প্রিন্ট মিডিয়াকে সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের থালিতে আরও বিশেষ কিছু পরিবেশন করতে হবে। সংবাদের পাশাপাশি আরও স্টোরি রাখতে হবে।তবেই পাঠক সেটা গ্রহণ করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আসামের প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে সেই কালচারটা এখনো গড়ে উঠেনি।এই কালচারটা যদি আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া আবার ঘুরে আসতে পারবে। সার্কুলেশনে যদি কোনো ফারাক এসেও থাকে সেটা আবার ঠিক হয়ে যাবে। ফলে রেভিনিউ অবশ্যই বাড়বে।

আপনার পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এক সমালোচনামূলক অভিযোগ ছিল যে, নির্বাচনের ঠিক আগে সরকার নিজের সুবিধার্থে একটা শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক পরিবর্তনে কিংবা তাদের পছন্দের সম্পাদককে নিযুক্ত করতে চাপ সৃষ্টি করেছে। আপনার মতে,এই অভিযোগটা কি সত্যি?

না। আমি তা মোটেই মনে করি না। যুগশঙ্খ কর্তৃপক্ষ এমন কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে বলে আমি মনে করিনা। আসলে আমিই নানা কারণে সরে যেতে চাইছিলাম। আমার আসলে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বরং আমি যুগশঙ্খ কর্তৃপক্ষের কাছে এখনও কৃতজ্ঞ। আর তাছাড়া গত কয়েক মাসের সম্পাদকীয় যদি ঘেটে দেখা যায়, সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই তেমন বেরোয়নি যে আমাকে সরানোর জন্য সরকার উঠেপড়ে লাগবে। যুগশঙ্খ তো বলতে গেলে সরকার সমর্থক, বিশেষভাবে কলকাতা সংস্করণ। তবে যদি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কেহ কেহ এ ধরনের পরিবেশ তৈরি করে থাকেন যে আমি থাকলে কোনো ধরনের অসুবিধা হবে, তাহলে সেটা আমি জানি না। তবে সেটাও আমার মনে হয় না।আর আমাদের মুখ্য সম্পাদক এধরনের কথাকে কতটুকু গুরুত্ব দেবেন কিংবা আদৌ দেবেন কি না সেটা জানি না‌। আমি তো একজন সাধারন মানুষ। আমার নামে তো আর পত্রিকা চলছেনা, পত্রিকার নামেই পত্রিকা চলছে। আমার থেকেও আরও বড় সম্পাদক অতীন দাস ছিলেন। তার চলে যাওয়ার পরও পত্রিকা পত্রিকার মতোই চলেছে।

সম্পাদক হিসেবে গত আট বছরে আপনার জন্য সবচাইতে বেশি চ্যালেঞ্জিং কি ছিল?

আমাদের যে ই-এডিশনটা করা হয়েছে, আমি কিন্তু সেটার বিরুদ্ধে ছিলাম। প্রস্তাবটা ছিল যে আমরা যদি ই-এডিশনটা শুরুও করি, তা কিন্তু বিকেলের পর দেব। প্রথমদিকে এরকম শুরু হলেও পরে কর্তৃপক্ষ আর সেটা মানতে রাজি হননি। তার ফলে কিন্তু যুগশঙ্খের সার্কুলেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এই ক্ষতির দায়ভার কিংবা দোষ সম্পাদকের উপরই বর্তায়। ব্রহ্মপুত্রেতো যুগশঙ্খের কোন বিকল্প নেই।যুগশঙ্খ বরাক উপত্যকায় যেমন সবচাইতে বেশি শক্তিশালী তেমন যথেষ্ট প্রতিযোগিতাও রয়েছে এখানে। তাই এই প্রতিযোগিতায় যদি আমাদের টিকে থাকতে হয় তাহলে সেরকম রসদ যোগান দিতে হবে। কিন্তু সেই ম্যাটেরিয়াল পেতে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানে যারা সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিক তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম ২০২১ এর নির্বাচন পর্যন্ত তারা যেন স্বস্থানে বহাল থাকেন। কারণ নির্বাচনতো দৈনিক পত্রিকার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। এদিকে প্রথম পাতায় ছাপানোর মত বরাক উপত্যকায় ঘটনা খুবই কম ঘটে থাকে। তাই বরাক উপত্যকার মানুষ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কি ঘটছে কিংবা দিসপুরে কি রাজনীতি চলছে তা জানতে উৎসাহী।অথচ তারপর আমাদের গুয়াহাটির ডেস্কও উঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছিল এবং তারা নিশ্চয়ই খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তার ফলে আমাদের কোয়ালিটি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। গুয়াহাটি সংস্করণ তো খুবই প্রভাবিত হয়। ফলে সার্কুলেশন কমে যায়। আর এর দায় আবার সম্পাদকের কাঁধে এসে পড়ে।

শুনেছি বাংলাদেশে পোর্টালগুলো খুব ভালো চলে। কিন্তু আমার যতটুকু মনে হয়, আসামে আমরা ঐ পর্যায়ে এখনও পৌঁছাইনি যে পোর্টাল এডিশন দিয়ে রাজস্ব উপার্জন করা যায়।

এই যে বললেন সার্কুলেশন কমে যাচ্ছে, তাতে করে কি আপনার মনে হচ্ছে যে এই যুব প্রজন্ম সংবাদপত্র পড়ছে না বলে এই অবস্থা। আর এ ক্ষেত্রে সম্পাদকের কি করা উচিত?

যুবা প্রজন্ম অর্থাৎ ‘টিনএজ’র জন্য কিন্তু আমাদের সংবাদপত্রে সপ্তাহে একটি বিশেষ পাতা বরাদ্দ ছিল। আমরা বেশ কিছুদিন পেইজটা চালিয়েছিলাম। তাছাড়া চার নম্বরের সম্পাদকীয় পাতায় ‘কথকতা’ বের হয়। যুব প্রজন্ম কি কি ভালো কাজ করছে এই নিয়েই এই পাতাটা। আমি আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে অনেক চেষ্টা করেছি যুব প্রজন্মকে জড়িত করার। কিন্তু এই প্রজন্মকে ধরা খুব শক্ত ব্যাপার। তাছাড়া ওরা বাংলাটাতো পড়েই না।

‘সবুজের মেলা’ বলে বাচ্চাদের একটা পাতা ছিল। পাঠকদেরকে জড়িত করার একটা চেষ্টা করা হত এর মধ্য দিয়ে। যেকোনো কারণেই হোক যুবশঙ্খ কর্তৃপক্ষ সেটা উঠিয়ে দেন।তাই আমরাও হয়তো এজন্য দায়ী। অনেক দরজা হয়ত আমরাই বন্ধ করে দিয়েছি।

আজকের দিনে সম্পাদক হিসেবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি, সার্কুলেশন কমে যাচ্ছে, রাজস্ব কমছে, না রাজনীতির প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ?

তিনটারই কিন্তু নিজস্ব চাপ রয়েছে। রাজনীতির একটা চাপ থাকে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। রাজনীতির ব্যাপারটাতে আগে কি হতো, কোন রাজনৈতিক নেতার যদি কিছু বক্তব্য থাকতো সেটা সম্পাদকের সঙ্গে হত। কিন্তু এখন সরাসরি মালিকপক্ষের সঙ্গে হয়, তারপর মালিকপক্ষ তার সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। আমি যদিও এখন পর্যন্ত এখানে এ ধরনের কিছুর মুখোমুখি হইনি।কলকাতায় কিছুটা চাপ থাকলেও এখানে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি। আর রাজস্বের ব্যাপারটাতে বলছি, সার্কুলেশন তো অবশ্যই কমেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার বাজার খারাপ সেটা তো সবাই জানে। এটা বাড়ানোর জন্য আমার তরফ থেকে অনেক চেষ্টাও করেছি।বেশ কিছু সিনিয়র স্টাফ সরে যাওয়ায় খুবই অসুবিধা হয়েছে।

পরবর্তীতে অরিজিৎ আদিত্যকে মানুষ কিভাবে পাবে? নাট্যকার, লেখক না একজন সাংবাদিক হিসেবে? তবে আপনি নাট্যকার,লেখক হলেও মূলত একজন সাংবাদিক। তাই এরপরের পরিকল্পনা কি?

হ্যাঁ, সবচেয়ে প্রথমে আমি একজন সাংবাদিক। তাই সাংবাদিক হিসেবেই কাজ করতে চাই। ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে কলকাতা সংস্করণের সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। প্রথম তিন মাস আমি এখান থেকে অন্তত তিনটা পেইজ লে আউট করে দিতাম। ওই সময় থেকে যেদিন আমি চাকরিটা ছাড়লাম সেদিন পর্যন্ত আমার কোন অফ্ডে ছিল না। আমার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তখনও উল্টো বেডে বসে ল্যাপটপে কলকাতার সংস্করণের জন্য কাজ করেছি। নিজের গলব্লাডার অপারেশনের সময় জ্ঞান ফেরার পর বিকেলে আমি মোবাইলে হেডলাইন দেখে দিয়েছি। হয়তোবা কোন নাটক দেখতে গেলাম কিংবা পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে রয়েছি অনবরত ফোন আসত এবং আমি ফোন রিসিভ করতাম। এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এগুলো নিঃসন্দেহে পারিবারিক জীবনকে প্রভাবিত করে। নাটক কিংবা সিনেমা দেখা, ব্যক্তিগত ভালো লাগার জায়গা গুলো ব্যাহত হচ্ছিল। জীবনে বিনোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে। তাই কিছুদিন রিলাক্স করে আবার নতুন করে শুরু করব।

বরাক উপত্যকায়ই কাজ করার ইচ্ছে, না বাইরে?

অবশ্যই বরাক উপত্যকায়। আমি গুয়াহাটির ছেলে, তাই ব্রহ্মপুত্র- বরাকেই আমি কাজ করতে চাই। আর সাংবাদিক হিসেবেই কাজ করতে চাই। আমরা যারা সাংবাদিকতায় এসেছি, আমরা সবাই জানি, যে যত বড় চেয়ারেই বসুক শেষ পর্যন্ত সেই ভাঙ্গা চেয়ারই ( যুগশঙ্খে যেভাবে বসতাম) আসল বাস্তব। ঐরকমই হয়তো আরও একটা ভাঙ্গা চেয়ার জুটবে। জুটলেও ঠিক আছে, না জুটলেও নিজের মতো করে কিছু করব। অবসর গ্রহণের সময় আসেনি, ইচ্ছেও জাগেনি।

Comments are closed.