Also read in

করোনা-কালেও কাঁটাতার থেকে ঝরে যাচ্ছে খণ্ডিত স্বাধীনতার রক্ত

কেমোথেরাপির ডেট পেরিয়েছে বেশ ক’দিন আগেই, ওষুধও প্রায় ফুরনোর পথে। কান্নান ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তিনি বলেছেন, একবার শিলচর মেডিক্যালে দেখিয়ে যেন ক্যান্সার হাসপাতালে আসে। লকডাউন ততদিনে শুরু হয়ে গেছে, তবু ক্ষীণ একটা আশা ছিল, বিএসএফ এখনও সকাল বিকেল ঘণ্টাখানেকের জন্য গেট খুলে দেয়। তাছাড়া জওয়ানগুলো লোক ভাল, রাত-বিরেতে কারোর শরীর খারাপ  হলে বা কারোর বাচ্চা বিয়ানোর ব্যথা চাগাড় দিলে গেট খুলে দেয়, এমনকী গাড়ি করে পৌঁছেও দিয়ে আসে। ফলে ডাক্তারের কাগজ দেখালে লাফাশাইল লক্ষ্মীবাজার থেকে কিছু একটা জোগাড় করে যাওয়া যাবে শিলচর। কেমোথেরাপি বলে কথা! কিন্তু আব্দুস সালামের যাবতীয় ভরসায় তালা লাগিয়ে এপ্রিলের দশ তারিখ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল গেট।

গেট বন্ধ মানে নো ম্যানস ল্যান্ডের এই মানুষগুলোর জীবনও স্তব্ধ। এই গেটই তাঁদের জীবন, এটা বন্ধ হয়ে গেলে চলবে কী করে তাঁদের জীবন! জওয়ানরাও নিরুপায়, কাঠ কাঠ মুখে বন্ধ গেটের ওপার থেকে শোনা যায়, ক্যয়া করেগা, ওপর সে অর্ডার হ্যায়।অব গেট নহি খুলেগা।

আব্দুস সালামের চোখের ওপর যেন বন্ধ হয়ে গেল জীবনের দরজা। কেমোর তারিখ পেরিয়ে গেলেও কি বেঁচে থাকা যায়? আব্দুস ভয় পান, ক্যান্সারের চেয়েও কী বেশি ভয়ংকর করোনা!

তা হলে কি বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে তাঁকে?

“শুধু বিনে চিকিৎসায় নয়, আমরা  মরবো না খেয়ে। গেট বনধ মানে আমাদের পেট বনধ।” কাঁটাতারের ওপার থেকে ভেসে আসে সাহিদ আহমেদের হাহাকার।

করিমগঞ্জের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের লাফাশাইল লক্ষ্মীবাজার এলাকাকে চিরে  দিয়েছে যে নির্মম কাঁটাতার, এর উল্টো দিকেই থাকেন আব্দুস সালাম,  সাহিদ আহমেদরা। তবে না, তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ নন, পুরো দস্তুর ইন্ডিয়ান। এনআরসিতে নাম উঠেছে, ফটে লাগানো কার্ড দেখিয়ে বুক ফুলিয়ে ভোটও দেন। রেডক্লিফ সাহেবের পাগলা কাঁচি নির্মম রসিকতায় দু দেশের স্বাধীনতা রচনা করেছিলেন, তিয়াত্তর বছর পরও তা তাড়া করে বেড়াচ্ছে আব্দুস-সাহিদদের।

হ্যাঁ, এঁরা নো ম্যান্স ল্যান্ডের না-ঘর-কা-না-ঘাটকা মানুষ।

করিমগঞ্জের এই স্থল সীমান্তে এ ধরনের ছয়টি জনপদ আছে। ‘গ্রাম’ বললে গ্রামও গাল ফোলাবে, কোথাও তো সেভাবে বসতিই নেই। তেসুয়ার কথাই ধরা যাক, গোটা এলাকায় পরিবার মাত্র দুটি। কুয়রাবাগ, কান্দিতে পাঁচটি করে পরিবার। দেওতুলিতে নয়টি। দুই অংকে পৌঁছেছে শুধু দুটো গ্রাম। লক্ষ্মীবাজারে ৫৭ ঘর, গোবিন্দপুরে ৩৭টি। ফলে এগুলোকে গ্রাম না বলে মহল্লা বলাই ভালো। এরমধ্যে গোবিন্দপুর ছাড়া বাকি সব কয়টি মুসলমান মহল্লা, গোবিন্দপুরের ৩৭ ঘরই হিন্দু তফশিলি মানুষের।

কাঁটাতারের এ প্রান্ত থেকে বাংলাদেশ দেড়শ মিটার দূর। ওইপারে অবশ্য কাঁটাতার নেই।  শোনা যায়, বিডিআর-কে ডিঙিয়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন মাঝে মধ্যে আসে, এ পার থেকেও যাওয়া-আসা হয়।

দুই বিবি আর ছেলে দিলোয়ারকে নিয়ে আব্দুস সালাম

 

এ সব শুনে হাসেন নুরুল ইসলাম। “বাংলাদেশ কি আমাদের বাঁচাবে স্যার? ওরা কি রিলিফ দেবে? শুনি তো, ও দেশেও লকডাউন”। নুরুল ইসলাম বিষয়ী মানুষ, কাঁটাতারের দু পারেই ঘর সংসার তাঁর। শুধু কি তাই, কংগ্রেসও করেন। তো, লকডাউনের সময় এ পারেই ছিলেন। বুধবার রাতে মোবাইলে প্রথম কথা নুরুল ইসলামের সঙ্গে৷ কাঁটাতারের ও পারে নেটওয়ার্ক পাওয়া টান, শুধু একটি কোম্পানির লাইন পাওয়া যায়। নুরুল ইসলাম জানান, ২২ মার্চ জনতা কারফিউ, এর দুদিন পর থেকে শুরু লকডাউন। তবে লাফাশাইল সীমান্তের ৩২ নম্বর গেটটা হররোজই খোলা হত। এমনিতে সকাল ছটায় গেট খুলে দেয় বিএসএফ। আবার বন্ধ হয় সন্ধে সাতটায়। শনি, বুধবার বাজার বসে, সে দিন এক ঘণ্টা ফাউ মেলে, গেট বন্ধ হয় রাত আটটায়৷

লকডাউন শুরু হওয়ার পর সকালে এক, বিকেলে আধ ঘণ্টার জন্য গেট খুলে দেয়া হত। লাফাশাইল লক্ষ্মীবাজারে এসে দুমদাম চাল ডাল তবু কিনে নিতে পারতেন ওঁরা। ১০  এপ্রিল থেকে গেট পুরোপুরি বন্ধ। গত পাঁচ দিন ধরে কিছু কিনে আনতে পারেননি, অনেক ঘরে খাবার বলতে তলানিতেও আর কিছু পড়ে নেই।

” থাকবে কী করে, আপনিই বলেন স্যার, সবাই দিন আনি দিন খাই মানুষ। এদের তো জমানো টাকা নেই যে লকডাউনের মধ্যে বাজারে গিয়ে বস্তা ভর্তি রেশন নিয়ে আসবে।” বলেন রাজ্জাক আহমেদ। চেন্নাইয়ে গাড়ি চালাতেন, বছর খানেক আগে গ্রামে ফিরে এসে ইনস্টলমেন্টে অল্টো কার কিনেছেন, সেটা নিয়েই ট্রিপ মারেন। মাঝ-কুড়ির রাজ্জাকের দুলাভাই হচ্ছেন আব্দুস সালাম। দিদি রাহেলার নিকাহ দিয়েছেন আব্দুসের সঙ্গে। তাঁদের এক ছেলে। দিলোয়ার হুসেন। পড়ে ক্লাস সিক্সে। সকালে গেট খুললে কাঁটাতার পেরিয়ে বিদ্যার্জনে যায় স্বাধীন ভারতের তেরো বছরের বালক দিলোয়ার। আব্দুসের আগের এক বিবি আছেন। নেহার বেগম তাঁর প্রথম পক্ষের। তো, নেহার বেগম ফোনে বলেন, স্বামীর কেমোর ডেট পেরিয়েছে, এখন ওষুধও ওভার। আজ চার দিন প্রায় না খেয়ে আছেন। তবে এমএলএ সেদিন এসে পরিবার পিছু তিন কেজি করে চাল দিয়ে গেছেন। ডাল-টালও দিয়েছেন। নেহার বলেন, সোয়ামি বেমারি, গলায় ক্যান্সার, আগে শহরে, গঞ্জে গিয়ে জন খাটত, সেটাও বেমার ধরার পর থেকে বন্ধ৷ নেহার বেগম নির্বিকার কণ্ঠে বলেন,  কী বেমার আইলো দুনিয়ায়, এ বার আমরা না খেয়েই মরব।

রাজ্জাক বলেন, বড় মানুষ যেমন তেমন, কিন্তু শিশুগুলোর অবস্থা একেবারে শোচনীয়। রাজ্জাকের বড় ভাই মনজুরআহমেদ। শহরে গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। লকডাউনের দিন থেকে তা বন্ধ। মনজুরের তিন মাসের একটা বাচ্চা আছে।  সেটি তিনদিন ধরে প্রায় উপোস। লকডাউনের পর থেকেই আর ল্যাকটোজেন আনা যায়নি। মনজুরের বিবি ফরিদুন্নেসা। মায়ের বুকের দুধই চলছিল, কিন্তু ফরিদুন্নেসা নিজেই কোনও দিন আধপেটা কোনও দিন উপোস  আছেন৷ বাচ্চাটা দুধ টানতে পারে না, ক্ষুধায় কাঁদে। রাজ্জাক বলেন, এখন তো কাঁদারও শক্তি নেই। গেট খোলা থাকলে করিমগঞ্জে গিয়ে ল্যাকটোজেনটা আনতে পারতাম৷ “বুঝলেন স্যার, বাচ্চাটার ক্ষুধার যন্ত্রণা আর চোখে দেখা যায় না।” নিষ্ফলা ক্রোধে হাহাকার করেন সমর্থ পুরুষটি।

তুলনায় নিরাপদ আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করি, রাজ্জাক ভাই, এখন কী করবেন আপনারা?

দোজবরের কাছে দিদিকে নিকাহ দিয়েছেন, সেই দিনমজুর দুলাভাইর কেমো আটকে আছে। আরেক ভাই রাজু, চেন্নাইয়ে কাজ করেন, লকডাউনে সেখানেই আটকে গেছেন, তিনিও প্রায় না খেয়ে আছেন। বাড়িতে মায়ের দুধ আর টানতে পারছে না মাস তিনেকের ভাইপো। চোখের সামনে কয়ামত দেখছেন রাজ্জাক, অথচ বন্ধ জীবনের গেট। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন রাজ্জাক। মোবাইলেও বুঝি, আসলে শব্দ হাতড়াচ্ছেন রাজ্জাক। এবং কয়ামতের মুখে দাঁড়িয়ে অসহায় মানুষ যা বলেন, ঠিক সেভাবেই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন রাজ্জাক।  “আল্লাহর কাছে সব ছেড়ে দিয়েছি স্যর। আমাদের হাতে আর কিছু নেই।”

প্রশাসনের ওপর বেজায় ক্ষোভ মহল্লার মানুষদের। বুধবার রাতে নুরুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসন থেকে কেউ আসেনি, কোনও চাল ডালও দেয়নি। মহল্লার পুরুষরা শহরে এসে কেউ মজুর খাটে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ বা অটো। বাকিরা খেত-কৃষির কাজ করেন। সব্জি ফলান, গেট পাস নিয়ে লক্ষ্মীবাজারে গিয়ে সেটাই হাটে বেচে আসেন। টেনেটুনে চলে যায় সংসার। কিন্তু লকডাউনের দিন থেকে সব বন্ধ৷ মহিলাদের নামে ব্যাংকে ৫০০ টাকা এসেছে, কিন্তু সেটা তোলারও রাস্তা নেই। তবু গেট খোলা থাকলে কিছু একটা উপায় হতো। গত পাঁচ দিন ধরে সেটাও বন্ধ।

“কীভাবে বাঁচি বলুন তো স্যার আমরা?” বড় জটিল করেন সাহিদ আহমেদ। নিজেই জবাব দেন, করোনা লাগবে না, না খেয়েই দেখবেন মরবো আমরা।

উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ অবশ্য  খানিকটা আশার কথাই শোনান। প্রশাসন থেকে  চাল ডাল আরও যা যা ন্যূনতম প্রয়োজন তা আজই দেবে। তিনি নিজেই প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কমলাক্ষ জানান, কাঁটাতারের ওইপারের সব কিছুই মূলত দিল্লি দেখে। তিনি প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, লকডাউনের পর যেমন চলছিল, আপাতত সেভাবেই চলুক, সকাল বিকেল মিলিয়ে অন্তত ঘণ্টা দেড়েক খোলা থাক গেট। এ ব্যাপারে আর্জি গেছে অমিত শাহের দরবারে। অন্তত তিনজনকে প্রতিদিন অনুমতি দেওয়া হোক শহরে এসে সব্জি বিক্রির। ওই তিনজনের জন্য খুলে দেওয়া হোক গেট।

হ্যাঁ, সেই গেট  যা এই নো ম্যানস ল্যান্ডের মানুষগুলোর কাছে আসলে জীবনের দরজা। যতটুকু চোখ যায়, শুধুই কাঁটাতার। কাঁটার তার। এর মধ্যে পেল্লাই এই গেট যেন  প্রাণের সিংহদুয়ার।

রেডক্লিফ সাহেব বড় অদ্ভুত খেলা খেলেছেন তাঁদের নিয়ে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এর জের টানছেন পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ আসদ্দর আলি, কেমো মিস করা মাঝবয়সি আব্দুস সালাম, ইনস্টলমেন্টে অল্টো কিনে ট্রিপে গাড়ি চালানো রাজ্জাক আহমেদ, মায়ের দুধ টানারও শক্তি হারানো তিন মাসের ওই উপোসি শিশুটি। কাঁটাতারই নসিব তাদের। স্বাধীনতার নামে  খণ্ডিত দেশের মানচিত্র নিয়ে মগ্ন রাষ্ট্রনেতারা বেমালুম ভুলে গেলেন তাঁদের ক্ষমতালোভ আর প্রাপ্তির ব্যালেন্সশিটে আটকে পড়া কিছু ব্রাত্যজন।

দেশ যখন স্বাধীন হয়, আসদ্দর আলি তখন দু বছরের ন্যানা। এরপর সাত সাতটি দশক পেরিয়ে গেছে৷ খণ্ডিত দেশ আরও খণ্ডিত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ। ততদিনে রেডক্লিফ সাহেবের ভূতও বোধহয় আরও একবার  মরে ভূত হয়ে গেছে। কিন্তু লাফাশাইল লক্ষ্মীবাজারের আসদ্দর আলির স্বাধীনতা সেই বন্ধক রয়ে গেছে কাঁটাতারের ওপারে। ওই যে গেটটা, বিশালাকৃতির নিষ্ঠুর চেহারার ওই যে গেটটি, সেটিই আসলে এঁদের আইডেন্টিটি। এই ভারত রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের বিলংগিংনেসের একমাত্র পথ।

করোনা এই পথও যে বন্ধ করে দিল। এখন দু দিকে তাকালে শুধু কাঁটাতার আর কাঁটাতার। অজস্র কাঁটার শেষহীন প্রাচীর। করোনা-কালেও আসদ্দর আলিরা হয়তো দেখেন, কাঁটাতার থেকে এখনও রক্ত ঝরছে।

Comments are closed.