Also read in

বাঙালির নিরাপত্তা বা সন্মান রক্ষার্থে বনধ নয়, সহযোগী হতে পারে কঠোর শ্রম

 

তিনসুকিয়ার ধলাতে পাঁচ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনার শোক আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শোকস্তব্ধ বাঙালি কান পাতলে এখনও যেন শুনতে পাবে ওদের শেষ আর্তনাদ! এই ঘটনার পর বলা যায়, বিশেষভাবে তাদেরকে হত্যা করার কারণ আমাদেরকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছে। পাঁচজনকে প্রাণ হারাতে হলো, কারণ তাদের অপরাধ ছিল তারা বাঙালি। আত্মসমর্পণকারী আলফার মুখপাত্ররা খোলাখুলি ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, আসামে বাঙালিদের অবস্থান বোঝাতে তারা ‘৮৩ র গনহত্যার পুনরাবৃত্তি করবে। তারা বা তাদের অনুগামীরা হয়তো এতেই প্রেরণা পেয়েছিল। ফলস্বরূপ পাঁচ নির্দোষ বাঙালিকে তাদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে, এর সংখ্যা কিন্তু আরো বেশিও হতে পারতো। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এ ধরনের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত নয়? অবশ্যই উচিত। কিন্তু আমাদের প্রতিবাদের ভাষা কিংবা প্রতিবাদ কাজে আসা উচিত, এর ফল পাওয়া জরুরি। না হলে এটি সময়ের অপচয় মাত্র এবং প্রতিবাদস্বরূপ পালিত এই বনধ একটি অতিরিক্ত ছুটি মাত্র!

বলা যায়, আজকের বরাক বনধের মতো বনধ বরাকে ঘটে আসছে ১৯৬১সাল থেকে। কিন্তু এর ফলে কতটা পরিবর্তন এসেছে? এতে হয়তো বাঙালিরা সাময়িক অবকাশ পেয়েছে কিন্তু স্থায়ী সমাধান আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? কিছুটা স্বস্তি ভাগ্যে জুটলেও এরপরই হয়তবা এনআরসি র মত জলন্ত সমস্যা বাঙালির সামনে এসে উপস্থিত হয়। আজ আসামের মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত তার দৈনন্দিন রুটিন এবং এমএসএমই প্রোগ্রামে। অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ব্যস্ত সাক্ষাৎকারে। তিনি তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি কেবল একটি জঙ্গি কার্যকলাপ এবং অন্য কিছু নয়। এই বনধে গুয়াহাটিতে ব্যাঙ্ক, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সব কিছুতে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম চলেছে।
তবে নিঃসন্দেহে বরাক উপত্যকা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠতে চেয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই বরাক উপত্যকা আজ অনেক স্লোগানে মুখরিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর মেঘালয় পর্যন্তও পৌঁছায়নি, গুয়াহাটি কিংবা দিল্লি তো অনেক দূর!

যদি এই বনধ বাঙালিদের সাহায্য করতে পারত বিশেষভাবে অস্তিত্বের সংকটে, তাহলে এই নিরপরাধ ৫ জনকে অসহায়ভাবে প্রাণ দিতে হতো না। বরাক উপত্যকার মানুষদের বোঝা উচিত যে বনধ কিংবা ” এটি ৮৩ নয়, বাঙালিদের আপনি স্পর্শও করতে পারবেন না” জাতীয় উত্তেজক পাল্টা বিবৃতি অবশ্যই সমস্যার সমাধান নয়। বরাক উপত্যকা এবং উপত্যকার বাঙালিদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বুঝে নেওয়া অতি আবশ্যক। বরাক উপত্যকার কতজন বাঙালি আইএএস, আই পি এস হয়ে ডিসি, এসপির মত সরকারি পদ অলংকৃত করেছেন? মন্ত্রিসভায় কতজন বাঙালি রয়েছেন? কতজন বাঙালি আছেন পূর্ত বিভাগ, সেচ বিভাগ সহ অন্যান্য সরকারি বিভাগে উচ্চ পদ অলংকৃত করে?

বরাক উপত্যকায় বাঙালিদের বুঝতে হবে যে এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে এবং দুঃখের বিষয় বাঙালি নিজেই এর জন্য দায়ী। বর্তমানে যুব সম্প্রদায় কোনক্রমে দ্বাদশ শ্রেণী পাস করতে চায়, তারপর চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোরের কোথাও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে চলে যায় এবং তারপর পড়া শেষ করে প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগ দেয়। যদি খুব মেধাবী হয়, তাহলে আইআইটি এবং এনআইটি বা এআইএমএস এ ভর্তি হতে চায়। কিন্তু খেলাধুলা, অভিনয়, সঙ্গীত বা পারফর্মিং আর্টের যে কোনো বিভাগে উপত্যকা থেকে জাতীয় স্তরে প্রতিনিধিত্ব নেই (ক্ষীণ ব্যতিক্রম থাকতে পারে) এখানে সহজেই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন?

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি যাকে অনুসরণ করা হচ্ছে, সেই বাঙালিটি কে? সৌরভ গাঙ্গুলী? অন্তত সমীক্ষাতো তাই বলছে, কিন্তু তিনি কি এই বর্বোরচিত হত্যার নিন্দা করেছেন? না তিনি করেননি। করেননি, কারণ তিনি খুব সম্ভবত এ সম্পর্কে কিছু জানেনই না। এখন যদি বিরাট কোহলি আসামের একজন বাঙালি হতেন, তাহলে হত্যার ঘটনাটি কতটা সবার মনসংযোগ আকর্ষণ করতে পারতো তা একবার কল্পনা করুন। সৌরভ গাঙ্গুলি নিজে হয়তো এটির তীব্র ভাষায় নিন্দা করতেন। কল্পনা করুন যে, দর্শক টানার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ইংরেজি সংবাদ চ্যানেলের এডিটর অর্ণব গোস্বামী যদি শিলচরের একজন বাঙালি হতেন তাহলে এই হত্যার ঘটনাটি জাতীয় স্তরে আলোচিত হত। আরো কল্পনা করুন, যদি রাম জেঠমালানি বা হরিশ সালভে শিলচর থেকে উঠে আসাএকজন আইনজীবী হতেন তাহলে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটির জোরদার শুনানি চলত। শিলচরের একজন বাঙালির যদি গভর্নর, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন সফল হতো তাহলে নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, কেউ কি সাহস পেত বাঙালিকে স্পর্শ করতে?

 

বরাক উপত্যকার যুবকদের সামাজিক দায়বদ্ধতা মেনেই এগিয়ে যেতে হবে জীবনের পথে। উজ্জ্বলতম মনের ছাত্রদের সিলিকন ভ্যালি নিয়ে নয়, ভাবা উচিত সরকারি দপ্তরে নিজেদের যোগদানের বিষয়টি নিয়ে । চৌকস যুবকদের গুগোলে আটকে না থেকে পাবলিক সার্ভিস নিয়ে ভাবা উচিত। স্পষ্ট বা দৃঢ় মতাধিকারী যুবকদের ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের নির্বাচনক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে তাদের দিসপুরে মনসংযোগ করা উচিত।

যদি একজন আফ্রিকান- আমেরিকান বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, যদি একজন কালো মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকাকে মুক্ত করতে পারেন, যদি একজন ‘চাও ওয়ালা’ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে শিলচর থেকে একজন বাঙালি কেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না? কেন পরবর্তীতে একজন শচীন টেন্ডুলকার বা বিরাট কোহলির মত তরুণ যুবক উঠে আসবে না শিলচর থেকে? শিলচরের মেয়ে লতা মঙ্গেশকর বা শ্রেয়া ঘোষালের মত কেন ছড়িয়ে দিতে পারবে না সর্বত্র সংগীতের সুর? কেন বাঙালিরা ডিসি ও এসপি হতে পারবে না, যদি রঞ্জন গগৈ বা হিমা দাস সাফল্য পেতে পারেন, তাহলে শিলচরের একজনেরও এভাবে সাফল্য পাওয়া উচিত। একবার যদি এমনটাই ঘটে কিংবা বরাক উপত্যকার বাঙালিরা এক হয়ে ওঠে তাহলে কোনো বাঙালি (হিন্দু বা মুসলিম)কে বাংলাদেশি বলার কারোর সাহস হবে না, সাহস হবে না বাঙালিদেরকে উইপোকা বলার।

 

আসামের বাঙালিদের দরকার নেতার, দরকার পাব্লিক ফেসের, দরকার উদ্যোক্তাদের,যে শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবে। প্রয়োজন রাজ্য কিংবা কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করার মত লোকেদের। বনধের মাধ্যমে আমাদেরএসব প্রাপ্তি অসম্ভব, একইভাবে উত্তেজক প্রতিক্রিয়াও আমাদের কিছু দিতে অক্ষম। বরং এক্ষেত্রে পরিশ্রম কিংবা দৃঢ় সংকল্প সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।

Comments are closed.