Also read in

না-পাওয়ার স্পর্শ

 

নেই, তবু সর্বক্ষণ সঙ্গী হয়ে আছে। দুটো জন্মদিন পেরিয়ে এবার তার তৃতীয় জন্মদিন, প্রসাদ নেই।এটা শুধু আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মানুষ তারাই নয়। যাদের সাথে হয়ত তার সামনাসামনি কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। দূর থেকে এক মুগ্ধ ভালোবাসায় তাকে দেখেছে, তাদেরও সারাদিন আজ এক শূন্যতা অনুভবের।

আবার এক অদ্ভুত সঙ্গ দিয়ে রেখেছে আজ প্রসাদ সারাটা দিন ধরে। কাছের দূরের যাদের সাথেই আজ দেখা হয়েছে বা দূরভাষে কথা হল, অনেকের কথাতেই ফিরে ফিরে এসেছে প্রসাদের কথা। সামাজিক গণমাধ্যমে বাঙালি বিশ্ব আজ কালিকাপ্রসাদের স্মৃতিতে ডুবে থেকেছে সারাদিন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বাঙালি ক’জন জন্মেছে যাকে মৃত্যুও উপস্থিতি কেড়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে? প্রসাদ মানুষের কোন তন্ত্রীতে স্পর্শ করতে পেরেছিল? যখন ছিল তখন তাঁর মধ্যে কী দেখতে পেয়েছিল বাঙালি যে তাকে হৃদয়ের এমন ‘গোপনবিজন ঘরে’ ‘মায়া’র আসনে বসিয়েছে। মায়া কথাটা এখানে সিলেটি অর্থে যার কোনো মান্য বাংলা প্রতিশব্দ হয় না। ‘তাইন আমারে খুব মায়া করইন’ বা ‘তারে দেখলে যে মায়া হয়’ বা ‘তোমারে আমি যে মায়া করি গো’ এই কথাগুলি জানি না বোঝাতে পারব কিনা, সিলেটি ভাষায় কথাটার মধ্যে ভালোবাসার কোন তেপান্তরের বিস্তার বা দীঘির অতল গভীরতা আছে। প্রসাদে এসে বাঙালি সব কাঁটাতার ভুলে যায়। শুধুই কি বাঙালি? বাঙালির ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশের সমাজের কাছে প্রসাদের জন্য তো একই আকুলতা। কেন?

কেন আমিই বা এত এত প্রিয়জনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারলাম এ জীবনে, কিন্তু প্রসাদে এসে আমার সব পারার অহংকার কেন খানখান হয়ে যায়? কেন এখনও একলা থাকার প্রতিটি প্রহরে প্রতিটি পলে অনুপলে সে অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে ভরিয়ে রাখে, কাঁদিয়ে রাখে? যখন ছিল, তখন প্রতিদিন কথা হত, দেখা হত? না, তো। তবে? আসলে জানতাম, প্রসাদ আছেই, একটা মাত্র ফোন কলের ওপারে শুধু। চাইলেই সব কথা বলতে পারি। সব আনন্দ, সব দীর্ঘশ্বাস, সব উচ্ছাস, সব বিষণ্ণতা- শোনাতে পারি। প্রতিধ্বনি শুনতে পারি অন্য প্রান্ত থেকে।

সমাজের আপামর মানুষ? তাদের কাছে সে তো ছিল একটি সামাজিক উপস্থিতি। কীসের গুণে সে তাদেরও ব্যক্তিগত ভালোবাসার ধন হয়ে উঠল?

বোধহয় মানুষের অনেক না-পাওয়া প্রসাদের গানে কথায় তাঁর কাজে ভাষা পেয়েছে। অনেক দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনি পেয়েছে তার মধ্যে। সমস্ত কাঁটাতারের দু’পারের থাকা মানুষের কাছে আসার আকুলতা এক অদ্ভুত মায়ায় প্রশ্রয় পেয়েছে প্রসাদের গানে। রাঢ়ের সনাতন দাস বৈরাগ্যর সাথে ভাটির শাহ আবদুল করিমকে মুখোমুখি করিয়েছে সেই তার গানে কথায়। জসীমউদ্দীনের ‘শোনো মোমিন মুসলমান’ আর রামপ্রসাদের ‘গিরি এবার আমার উমা এলে’কে একতারে বেঁধেছে কে আগে? পদ্মাপুরাণের বেহুলার বিলাপের সাথে কে মিশিয়েছে আগে কারবালার ক্রন্দনের জারি সুর? আর এই কাজটি করেছে সে এক গভীর বিশ্বাস থেকে। শুধু বিশ্বাস নয়, তার ছিল এক ব্যতিক্রমী সবিনয় নিবেদন। অথচ যে কাজটি সে করেছে তা কিন্তু এক বিপুল সাংস্কৃতিক জাগরণের নামান্তরই। শুধু মঞ্চে মঞ্চে গান গেয়ে বেড়ানো ব্যস্ত শিল্পীর দিনলিপি ছিল না তার জীবন। উনবিংশ শতকে জন্ম নেওয়া আমাদের অপূর্ণ আধুনিকতা বিংশ শতকে পথভ্রষ্ট হয়েছিল, তীব্র সুতীক্ষ্ণ সমালোচনায় তাকে বিদ্ধ করে সে চেয়েছে লোকায়তের একতারার সুরে তাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে। ভাঙা বাংলার শূন্য বুকে সে স্বপ্নের সারিগানের মত জেগে উঠেছে। আত্মপ্রচারের রুচিহীনতার পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে সংবাদ মাধ্যমের একান্ত সাক্ষাৎকারে তার আলাপনে মানুষ খুব কমই শুনেছে ‘আমি’র কথা। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল ‘তাহাদের কথা’। তারা মানে লোকায়ত থেকে আবিশ্ব মানুষের সাংস্কৃতিক মহাজনেরা।

এমন ভরসার ভালোবাসার ‘নাও’-এই মানুষ সওয়ারি হতে চায়। সেই নাওয়ের মাঝি মাঝনদীতে ফেলে চলে গেলে সবহারানোর হাহাকার তো উঠবেই নৌকো জুড়ে। একটা ভাঙা স্বপ্নের হারানো বিশ্বাসের সময়ে প্রসাদ হয়ে উঠেছিল একটা মায়ার বন্দর।

জন্মদিনে সে জন্যই একটা শূন্যতার হুহু বাতাস। আবার সারাক্ষণ এক সহজ সুরের গুণ গুণ।

Comments are closed.