Also read in

পরাজয়

ব্যালকনি থেকে রাস্তা দেখতে বেশ ভালই লাগছিল অহনার। একা শুয়ে থাকা পিচ কালো রাস্তা, চকচক করছে দুপুরের রোদে। চোখ যায় যত দূর, ততদূর কেউ নেই। চারদিক শুনশান। শুধু এক নেড়ি কুকুর রাস্তার এপাশ-ওপাশে ছুটছে, ল্যাজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে।

লকডাউনে চারপাশটা শান্ত। যেমনটা হয় ছোটদের স্কুলে। কচিকাঁচার কিচিরমিচির যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই দুম করে স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়েন। ব্যস,এমনি সব চুপ। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স! করোনাও যেন ব্যস্ত জীবনে বদ মেজাজি স্যারের মত ঢুকে পড়ল।

কতদিন এমন রোদ জ্বলা নির্জন,নিস্তব্ধ দুপুর দেখেনি অহনা। প্রাইভেট কোম্পানিতে তো দম ফেলার ফুরসত নেই। গাড়ির কাচের ফাঁকে,অফিসের জানালা দিয়ে কতটাই বা নিবিড় ভাবে একটা দুপুর দেখা যায়! শুধু চারপাশ জানান দেয়, সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে গেছে। ক্লান্ত সূর্য আড়মোড়া ভাঙছে,ঘুমোতে যাবে বলে।

অহনা ওর একাকী নির্জন জীবন আর লক ডাউনের স্তব্ধতা, দুটোর মধ্যে একটা মিল খোঁজার চেষ্টা করছে। আজ সকাল থেকেই সে অনবরত পুরনো দিনের ছবি হাতড়াচ্ছে বুকের ভেতর। আসলে প্রতিটা মানুষের বুকের দেওয়ালেই তো একটা দেরাজ থাকে। যেখানে একান্ত আপন স্মৃতিরা জমা হয়। অহনা প্রাণপণে সেই দেরাজটা খোলার চেষ্টা করছে। গাদাগাদি করে রাখা স্মৃতি থেকে বের করে আনতে চাইছে কোলাহল মাখানো তার জীবনের ধূসর দিনগুলোকে। আর এ সবটা স্মৃতিইতো দীপংকরকে নিয়ে।

দীপংকরের সঙ্গে অহনার ডিভোর্স, আজ থেকে সাত বছর আগের ঘটনা। কলেজে থাকতে তাদের প্রেম, তারপর বিয়ে। দু বছর পর জন্ম ছেলে দীপ্তাংশুর।

মা হওয়ার কোনওদিনই ইচ্ছে ছিল না অহনার। বরং ওর পছন্দ ছিল লিভ ইনে। কাচ্চাবাচ্চার ঝামেলা কে পোয়াবে! বরং চুটিয়ে উপভোগ করা যাবে দাম্পত্য। সঙ্গে ঝা চকচকে একটা কেরিয়ার।

দায়িত্বহীন শারীরিক সম্পর্কে রাজি ছিল না দীপংকর। ওর চাপেই শেষমেশ বিয়ের পিঁড়িতে বসল অহনা। কিন্তু ওর ডোন্ট কেয়ার ভাবটা যেই কে সেই থাকল।

সেকেলে ধারণার শাশুড়ি। খাদ্য রসিক হলহলে স্বভাবের শ্বশুর। অবিবাহিত এক ননদ। আর বাড়িতো নয়, যেন হোটেল! এই আত্মীয় আসছে,ওই আত্মীয় যাচ্ছে। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার যাকে বলে!

বাবা-মা’র আদুরে একমাত্র মেয়ে অহনার কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে একা বড় হয়েছে। বাড়িতে এত মানুষজনের যাওয়া-আসা দেখেনি। কেমন যেন অসহ্য লাগত ওর। সকাল সকাল অফিসের জন্য বেরিয়ে যেত দুজনেই । বিকেলে এক সঙ্গে ফিরত। জোর করে নিজেকে সেট করার চেষ্টা করেও অহনা ব্যর্থ হয়েছে বারবার।

এভাবেই কেটে গেল তিন বছর। সংসার আসলে সবার সয় না। সুখের বাসা ভাঙলেই যেন কেউ কেউ শান্তি পায়। যেমন অহনা। বাড়ি থেকে আলাদা হওয়ার জন্য দীপংকরকে চাপ দেওয়া শুরু করতেই পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যায়। দুজনের মধ্যে থাকা ভালবাসার বাঁধন দ্রুত আলগা হতে হতে এক সময় বিবাহ বিচ্ছেদের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। শেষমেষ তাই হয়। ছেলে দীপংকরের কাছে থাকে। অহনা সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাপের বাড়ি চলে যায়। ছেলের জন্যও ওর চোখে জল আসেনি।

তারপর নদী দিয়ে কত জলই গড়িয়ে গেল। দীপংকরের বাবা-মা গত হলেন। ছেলেও অল্প অল্প বড় হলো। সেযুঁতিকে বিয়ে করল দীপংকর। আদ্যপান্ত সংসারী মেয়ে।

দীপংকর ফের এক মেয়ের বাবা হলো। পুরোদস্তুর সংসারী এখন সে। সেযুঁতিও শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে রেখেছে। তবে অহনা বিয়ে করেনি।

অহনার বাবা- মাও একে একে চলে গেলেন। মেয়ে আর বিয়ে করবে না, এটা তারাও ভাল জানতেন। তাই আস্তে আস্তে নিজেদের আশাগুলোর গলা টিপে দিয়েছিলেন।

ক্রমে একা হয়ে গিয়েছলো অহনা। এত বড় বাড়িতে সে একাই থাকতো। ইগোটাও ভীষণ ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো। একটা তীব্র ঘেন্না জন্মেছিল দীপংকরকে নিয়ে। কিন্তু একা বড় হওয়া অহনা মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য আকুল হয়ে পড়ত। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় ছিল না।

কলিগ পলাশের সঙ্গে সম্পর্কটাও শেষমেশ মুখ থুবড়ে পড়ে। অহনা ক্রমে টের পাচ্ছিল ওর ভিতরেই একটা গলদ আছে। যা ওকে জীবনে থিতু হতে দেয় না। শুধু মাত্র শরীর দিয়ে কিছু হয় না। রক্ত,মাংস, মিউকাস মেমব্রেনের নিচে থাকা মনটাকে মন দিয়ে ছুঁতে হয়। সবাই হয়ত মনকে ছোঁয়ার বিদ্যাটা জানে না।

লকডাউন হবার পর থেকে একা জীবনটাকে আরও একা মনে হচ্ছে অহনার। তবে অখণ্ড অবসর কখনও কখনও নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায় মানুষকে।

দীপংকরকে হঠাৎ করে কেনই বা এত করে মনে পড়বে অহনার! যাকে সে সটান মুখের ওপর বলে দিয়েছিল, ‘তুমি জাস্ট একটা ইডিয়ট। তোমার মত মানুষের মুখে আমি থুথু ফেলতেও ঘেন্না করি।” সেই মানুষটার জন্য ওর মন কেমন করছে!

গতকাল ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে অহনা দীপংকরের ফোন নম্বর বের করেছে। এটাতেই ওর হয়াটসঅ্যাপ। একজন বিবাহিত পুরুষকে ওরই প্রাক্তন স্ত্রী গায়ে পড়ে মেসেজ পাঠাবে— এটা কেমন কথা। যদি দীপংকরের স্ত্রী কিছু মনে করে। দীপংকর যদি রিপ্লাই না দেয়। একসঙ্গে অনেকটা প্রশ্ন পোকার মত কামড়ে ধরলো অহনার মাথায়।

রাতে ভাল ঘুম হয়নি । দুপুরে ভেবেছিল ঘুমাবে,কিন্তু না, ঘুম এলো না অহনার। দুপুরে তন্দ্রার মত ভাবটা এলো ঠিকই, কিন্তু হঠাৎ মনে হলো দীপংকরের পুরুষালি ঠোঁট ওর ঠোঁট ছুঁয়েছে। কেঁপে উঠল অহনা। না, আর পারা যাচ্ছে না। অজান্তেই দীপংকরের ফোন নম্বরটা ডায়াল করে ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে আবার কেটেও দিলো।

ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে অহনার বারবার মনে হচ্ছে সে হেরে গেছে। কিন্তু কখনও হয়ত মানুষ ইচ্ছে করে হারতে চায়। ছোটবেলা এক আধটু গান গাইত সে। বড় হয়েও ছিল অভ্যেসটা। একটা রবীন্দ্রসংগীত খুব পড়ছে আজ। ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি’। দু এক কলি গুনগুন করল সে।

অনেকদিন পর গান গাইল অহনা। এত বছর পর নিজের গলা শুনে সে নিজেই অবাক। কতক্ষণ গুনগুন করলো সে নিজে টের পায়নি।সম্বিত ফিরলো মোবাইলের রিংটোনে।

বিছানায় রাখা ফোনটা বাজছে। কিন্তু অহনার ভেতরের নীল বন্দরে তখন সুনামির ঝড়। যে মানুষটাকে সে ভালবেসেছিল, ঘেন্না করেছিল, ওর জন্য সে আজ হন্যে- আকুল। এটা কি কোনও তীব্র অবাস্তব আবেগ। না একটা পরাজয়। কিন্তু অহনা তো হারতে শেখেনি। না আজকে ওর হেরে যাওয়াটা উচিত!দ্বিধা-দ্বন্দের আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত মনের দেয়াল, অবশ হয়ে আসছে সমস্ত শরীর।

অহনা দৌড়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়, কিন্তু রিসিভ করে না।

ফোনটা বেজেই যাচ্ছে।

 

[লেখক বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য পত্রিকা ‘স্ফুলিঙ্গ’র সম্পাদক। লেখালেখি শুরু হয়েছিল ২০০৪ সাল থেকে।লেখকের গল্প- কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায়]

 

Comments are closed.