Also read in

লড়াই শেষ! নাগরিকত্ব ছাড়াই পৃথিবী ছাড়লেন ১০৪ বছরের চন্দ্রধর দাস

২০১৮ সালে ১০২ বছরের ভারতীয় নাগরিক চন্দ্রধর দাসকে বিদেশি ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল, কারণ অসুস্থতার জন্য সময়মত আদালতে হাজির হতে পারেননি তিনি। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলচর সেন্ট্রাল জেলে, সেখানে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। মানবিকতার খাতিরে জামিন পেলেও মিটে যায়নি তার মনের যন্ত্রণা। প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির একান্ত ভক্ত চন্দ্রধরের শেষ ইচ্ছা ছিলো, তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মারা যাবেন। তাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার মতো ব্যবস্থাও ছিল, শুধুমাত্র প্রশাসন এবং সরকারের উদাসীনতা ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়াই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি। রবিবার রাতে আমরাঘাটের বড়াইবস্তিতে নিজের বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়েছে। রাতেই তার মৃতদেহ দাহ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।

তার মেয়ে নিয়তি রায় এবং তার ভাই টানা দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন, নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েও বাবার জন্য নাগরিকত্ব জোগাড় করতে পারেননি। নিয়তি বলেন, “এত শক্তমনের মানুষ ছিলেন বাবা এটা না দেখলে বোঝা যায়না। এত কষ্ট করার পরেও তিনি জানতেন তার ধর্ম হিন্দু এবং দেশ ভারতবর্ষ। শেষ ইচ্ছে একটাই ছিল ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ভারতের মাটিতেই মারা যাবেন। ভারতের মাটিতে মারা গেলেও তার পরিচয় ভারতীয় বলে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেনি এই দেশের আইন। এখন তিনি যেখানে চলে গেছেন, সেটা যেকোনও আইনের ঊর্ধ্বে, আর কোনও লড়াই করতে হবে না, সব লড়াই শেষ। আমরা এখন আর চিন্তা করিনা, সঙ্গে মা রয়েছেন, এবার তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাউকে দোষারোপ করিনা অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সরকার হয়ত দেশের ভালোর জন্যই এসব কাজ করছেন। আবারও যদি লড়াই করতে হয় আমরা করব। তবে বাবা নাগরিকত্ব ছাড়াই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন এই ব্যথা হয়তো সারা জীবন ভুলতে পারবোনা।”

ধলাই বিধানসভা সমষ্টির অন্তর্গত আমরাঘাট এলাকার বাসিন্দা চন্দ্রধর দাসের মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। ২০১৮ সালে ফরেইনার্স ট্রাইবুনাল তাকে এক্সপার্টি রায়ে বিদেশি ঘোষণা করে। তাকে নোটিশ পাঠানো হয়েছিল কিন্তু শারীরিক অবস্থার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে আদালতে সম্মত নিয়ে আসতে পারেননি। এই দোষে তাকে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছিল। ১০২ বছর বয়সে শিলচরের সেন্ট্রাল জেলে থাকা ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয় তাকে। তার মেয়ে নিয়তি দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এই গ্রেফতার আটকাতে পারেননি। তার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে এবং পৌঁছে যায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কাছে। তারা প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে চন্দ্রধর দাসের মুক্তির আবেদন জানাতে শুরু করেন। তৎকালীন জেলাশাসক এস লক্ষণনের সহায়তায় তার মুক্তি হয়। তবে বাড়ি যাওয়ার পরেও তাকে বারবার ট্রাইব্যুনালের আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে, শেষমেষ মানবতার খাতিরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাকে আর আদালতে হাজিরা দিতে হবে না, তার মেয়ে এবং ছেলে মিলে কাজটি করবে।

 

 

চন্দ্রধর দাস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। দৈনিক যেমন ঠাকুরের পুজো করতে হয়, প্রায় তেমনটাই করতেন, নিয়মিত মোদির ভাষণ শুনতেন। ভাষণ শুরু হওয়া মাত্র হাত জোড় করে প্রণাম জানাতেন, যেন কোনও ঈশ্বরের অবতারকে প্রণাম জানাচ্ছেন। চন্দ্রধর বলতেন, ‘আমি হিন্দু এবং ভারতবর্ষ আমার দেশ, এই জন্মে নিজের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার পর মরতে চাই, এর আগে নয়। আমি জানি নরেন্দ্র মোদি আমার ইচ্ছে পূরণ করবেন। তবু ভয় হয় যদি বিদেশি তকমা নিয়ে ভারতবর্ষে মরি তাহলে আমার মৃত্যুর পর পরিবারের কি হবে?”

তার স্ত্রী আদরমনি দাস বলেন, ‘আমার স্বামীকে যখন জেলে নেওয়া হয়েছিল, তখন মোদি-বাবা খবর পেয়েছিলেন। তিনি ফোন করে আমার স্বামীকে মুক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। শুধু এখানেই শেষ নয় আমরা এই যে ভারতের মাটিতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি এটাও মোদিবাবা-ই করছেন। তবে জানিনা তার বানানো আইন আমাদের শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবে কিনা। আজ আমার স্বামী চলে গেছেন, কাল হয়তো আমিও চলে যাব। তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাননি, তবে এই দেশে সসম্মানে তার মৃত্যু হয়েছে। একজন হিন্দু হিসেবে ভারতের মাটিতে সসম্মানে মরতে পারা আমাদের শেষ হচ্ছে, এর থেকে বেশি কিছু চাই বলুন? বাকিটা বুঝিনা তবে কষ্ট হয় আমার দুই সন্তানের জন্য, হয়ত তাদের কাঁধে বোঝা হয়ে গেছি।”

 

 

চন্দ্রধর দাসকে যখন ২০১৮ সালে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রথম খবর পেয়েছিলেন সমাজসেবী কমল চক্রবর্তী। অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রত্যেকের কাছে খবরটি পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং একটা এমন আলোড়ন তৈরি হয়েছিল এতে তার জামিনের পর অনেকটা প্রশস্ত হয়। এরপরে দেশ-বিদেশের নানান সংবাদসংস্থা চন্দ্রধর দাসের কথা লিখেছে। কমল চক্রবর্তী মনে করেন, সরকার চাইলে গ্যাজেট নোটিফিকেশনের সহয়তায় চন্দ্রধর দাসকে নাগরিকত্ব দেওয়া যেত। তিনি বলেন, “আজ চন্দ্রধর দাস সমস্ত লড়াইয়ের উর্ধে চলে গেছেন, তার কাছে আর কোনও দেশের নাগরিকত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এটা পুরো সমাজ ব্যবস্থার কাছে একটা বড় ব্যর্থতার নিদর্শন। সরকারপক্ষের এত প্রচার, এত কথা-বার্তা এই একটা জায়গায় এসে যেন ব্যর্থ হয়ে গেছে। আইনের ব্যবস্থা ছিল, গ্যাজেট নোটিফিকেশনের সাহায্যে তার নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা যেত। তবে সরকার এবং প্রশাসন উদাসীন থাকলেন। এমন নিদর্শন আরও রয়েছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবারও হবে। আজ মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে কারণ জীবনে একটাই ইচ্ছা ছিল চন্দ্রধর দাসের, তিনি ভারতীয় নাগরিক হয়ে তারপর মারা যাবেন, আমরা পারলাম না তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে।”

চন্দ্র দাসের ট্রাইব্যুনালে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন সৌমেন চৌধুরি। তিনি বলেন, “সরকার উদাসীন না হলে চন্দ্রধর দাসকে নাগরিকত্ব দেওয়া যেত। এক বছর আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হয়েছে, এটা নিয়ে প্রচার হয়েছে, উল্লাস হয়েছে। অথচ এক বছরে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম বানাতে হয়, সেটা বানায়নি সরকার। অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রে তিন মাসের মধ্যে এই নিয়ম গঠন করা হয় কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকত্ব আইনের ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখালেন সরকার। এই একটি ঘটনা আবার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা কতটুকু ব্যর্থ। মানুষটা বড় প্রাণবন্ত ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে চাইছিলেন, আজ মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে।”

Comments are closed.