Also read in

কিছু দেখা, কিছু শোনা- এ শহরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা

এখন মনে হয় কতটা সৌভাগ্যের ছিল আমার ছাত্রজীবনের দিনগুলো। তখন মূল্য বুঝি নি। বুঝি নি বলেই চোখের সামনে এই শহরের যে মানুষ রতনদের দেখেছি, তাঁদের কথা উত্তর প্রজন্মকে বলার প্রয়োজন মনে করি নি। এটা শুধু আমার অপরাধ নয়, আমাদের অপরাধ।

স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উৎসব চলছে মাটিতে, নেটে। পতাকার বা প্রতীকের যতটা উদযাপন হচ্ছে, ততটা উচ্চারণ সেদিনের সংগ্রাম বা সংগ্রামীদের নিয়ে হচ্ছে না। অথচ উদযাপন তো এমনও হতে পারত, প্রতিটি শিক্ষার্থী তার বাসস্থান অঞ্চল বা শহরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম লিখে আনুক। পাড়ায় মহল্লায় প্রবীণদের সাথে কথা বলে, গ্রন্থাগারে যে সামান্য তথ্যপঞ্জী আছে তা ঘেঁটে দেখুক। এই ক’টা দিন নিজ নিজ অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের নিয়ে মগ্ন থাকুক। এমন তো হতেই পারত, প্রতিটি শহরের পৌর প্রশাসন সেই শহরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম তালিকাবদ্ধ করে তাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ছোট ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করত এই সময়ে।

এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল শ্যামাচরণ দেবের কথা। মায়ের কাছে শুনেছি তাঁকে শিলচরের গান্ধী বলা হত। ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বদেশি শিক্ষা ব্যবস্থার সমান্তরাল প্রবর্তন করেছিলেন স্বদেশি বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে। আজকের দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়ই হল অতীতের সেই স্বদেশি স্কুল। এই স্কুলের সাইনবোর্ডে এখনও দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়ের পর বন্ধনীর ভেতর লেখা হয় স্বদেশি স্কুল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যোগ দিয়ে যারা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন তাদেরকে নিয়েই শুরু হয়েছিল শ্যামাচরণবাবুর স্কুল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সেলাই ও অন্যান্য হাতের কাজ ছিল পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত। গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুলের স্মরণিকায় প্রথম দেখেছিলাম শ্যামাচরণ দেবের প্রতিকৃতি। পরবর্তী সময়ে স্বদেশি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার ঘরেও দেখেছি তাঁর বাঁধানো ছবি। হঠাৎ মনে হল নেট ভূবনে সার্চ করে দেখি শ্যামাচরণ দেব নামটি দিলে কী উত্তর আসে! হয়ত কেউ না কেউ তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে রাখতে পারে প্রতিকৃতি সহ। আমাকে হতাশ করে দিয়ে নেট জানালো শ্যামাচরণ দেব বিদ্যাপীঠের কথা। বলল, এই বিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী শহরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এখন। আমি নিশ্চিত আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শ্যামাচরণ দেব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে এই তথ্যটুকুই তারা দেবে।

 

 

মনে পড়ে, এই শহরে ছোট্টখাট্টো একটি মানুষ ছাতা হাতে সেন্ট্রাল রোড দিয়ে হেঁটে যেতেন। পঙ্খীরাজ নামে একটি শিশু কিশোর পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেন্ট্রাল রোডের ভট্টাচার্য পরিবারের বাড়িটিকে শহরের আজকের প্রজন্ম চেনে কালিকা প্রসাদের বাড়ি হিসাবে। ওই বাড়িরই কবিরাজ সন্তান কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের কোঠাটির দৈনন্দিন আড্ডায় আসতেন সেই মানুষটি। তাঁর নাম জ্যোতির্ময় সেন। স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশন ঘোষিত হয়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামী সংস্থা গড়ে সরকারের কাছে সকল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেনশনের জন্যে ছোটাছুটি করতেন। কালীপ্রসন্ন, জ্যোতির্ময় এরা সকলেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারার সদস্য। কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের মুখেই শুনেছি মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লববাদী সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে এই শহরে এসেছিলেন। কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের মনে আছে পুকুরঘাটে স্নানরত একজনকে দেখিয়ে তাঁর সতীর্থ বলেছিল, ওই দেখো মাস্টারদা স্নান করছেন। পেছন থেকে একটি মাত্র পলকই দেখেছিলেন তিনি মাস্টারদাকে। বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্যের স্বপক্ষে প্রচার করতে বিপিনচন্দ্র পাল শিলচরে এসেছিলেন। উকিল পট্টির বর্তমানে বিক্রি হয়ে যাওয়া দত্ত বাড়িতে বক্তৃতা করেছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল। ওই সভায় শহরের নারীরা চিকের আড়াল থেকে গান গেয়েছিলেন, না জাগিলে এ ভারত ললনা এ ভারত আজ জাগে না জাগে না। এই শহরেই মুকুন্দদাস এসে গেয়েছিলেন ‘ভেঙে ফেলো রেশমী চুড়ি বঙ্গ নারী, কভু হাতে আর পরো না’। খিলাফত আন্দোলনের সূত্রে মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন এই শহরে। পুরোনো ফাটক বাজারের মাছ পট্টির পেছনে তাঁর সভা মঞ্চ হয়েছিল।

 

তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন সেই সময়ের বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা আলী ভ্রাতৃদ্বয়। মহাত্মা গান্ধীর কাছাড়ে আগমন বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। এ অঞ্চলের ধামাইল গানে সেই সফরের উল্লেখ আছে। আমার শিক্ষক অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের গবেষণায় সেই গানগুলি সংগৃহীত হয়েছে। আমরাও গেয়েছি। আমি আর কালিকা শিলচর দূরদর্শনের জন্যে ‘শিলচর শহরে মহাত্মা গান্ধী’ শিরোনামের একটি প্রামাণ্যচিত্র করেছিলাম। দেবব্রত দত্তের একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার আছে তাতে। অধ্যাপক দত্ত বলেছিলেন, মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে কাছাড়ের চা শ্রমিকেরা সে সময়ে মদ্যপান বর্জন করেছিলেন। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের লক্ষ্যে আর্যপট্টির দুর্গাবাড়ি প্রাঙ্গনে পংক্তি ভোজন হয়েছিল, যেখানে পাশাপাশি বসে অন্ন গ্রহণ করেছিলেন উকিল পট্টির বিশিষ্ট মানুষ ও নাগা পট্টির সাফাই কর্মীরা। জাতীয় স্তরে স্বীকৃতি অর্জনকারী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এ শহরের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন কামিনী কুমার চন্দ ও অরুণ কুমার চন্দ, পিতা ও পুত্র দুজনে। বালাধন চা বাগানের গোরা সাহেবের হত্যার অপরাধী মনিপুরি যুবকদের তিনি দীর্ঘ আইনী লড়াই লড়ে ‘বেকসুর খালাস’ করে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। বালাধন হত্যা মামলা সেসময় সারা দেশে সাড়া জাগিয়েছিল। মনিপুরি সমাজ কামিনী কুমার চন্দকে পিতার মত সম্মান করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর কাছাড়ের মনিপুরি সমাজ তাঁদের পরম্পরাগত নিয়মে অশৌচ পালন করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেছিল। তাঁর পরিবারের সাথে ঠাকুর পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর এক সন্তান অনিল কুমার চন্দ রবীন্দ্রনাথের সচিব ছিলেন। আরেক সন্তান অপূর্ব কুমার চন্দের আদলেই রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছিলেন তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের অমিত রায় চরিত্র। চন্দ পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান অরুণ কুমার চন্দ। তিনি শুধু কাছাড়ের জননেতা ছিলেন না। কাছাড় সিলেট সহ গোটা আসাম রাজ্যের রাজনীতিতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। অকালমৃত্যু তাঁকে কেড়ে না নিলে তিনিই হতেন স্বাধীনতা উত্তর ভারতে এ অঞ্চলের শীর্ষতম জাতীয়স্তরের নেতা। স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি এই অঞ্চলের শ্রমিক আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব।

 

অরুণ কুমার চন্দ

 

অরুণ কুমার চন্দের দক্ষিণহস্ত বলে পরিচিত ছিলেন পরবর্তী সময়ের রাজ্যস্তরের কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। অরুণ কুমার যখন কাছাড় কংগ্রেসের সভাপতি, তখন সম্পাদক ছিলেন অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেছিলেন অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। সিলেট জেলে বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্যের ফাঁসির সময়ে অচিন্ত্য ভট্টাচার্য ছিলেন ওই জেলেই বন্দী। তাঁদের ওয়ার্ডটি ছিল ফাঁসিঘরের লাগোয়া। দেওয়ালে অনেক উঁচুতে থাকা একটা গর্ত দিয়ে ফাঁসিঘর দেখা যেত। একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠলেই গর্তের কাছাকাছি পৌঁছানো যেতো। বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে রোগা ও লম্বা ছিলেন অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। তাই তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ফাঁসির সময় ওপরে উঠে সেই গর্তে চোখ রেখে ঘটনার সাক্ষী হওয়ার। অচিন্ত্য ভট্টাচার্যের মুখে এই দিনের কথা অনেক শুনেছি। তিনি অসিত ভট্টাচার্যের মূর্তি উদ্বোধনের স্মরণিকায় এই কথা লিখেও ছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে সারা দেশেই মুসলিমদের মধ্যে ছিল দু’টি ধারা। একটি মুসলিম লিগ পন্থী। আরেকটি কংগ্রেসের সহযোগী জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের জমিয়তপন্থী ধারা। মইনুল হক চৌধুরী ও জিলানী চৌধুরী মুসলিম লিগের সাথে যুক্ত থাকলেও তৎকালীন কাছাড়ের মুসলিম রাজনীতির প্রধান অংশ ছিল অখণ্ড ভারতের সমর্থক জাতীয়তাবাদী জমিয়তপন্থী ধারা। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লিগের অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার এক মাসের মধ্যে দিল্লিতে সিন্ধু প্রদেশের মুসলিম লিগ বিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী আল্লা বক্সের নেতৃত্বে ‘আজাদ মুসলিম কনফারেন্স’ আয়োজিত হয়েছিল। এই সম্মেলন পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অখণ্ড ভারতের পক্ষে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ডাক দিয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী আকারে ও প্রতিনিধিত্বে এই সম্মেলন লাহোরের মুসলিম লিগ সম্মেলনের চেয়ে অনেক বড় ছিল। বিপুল জনসমাগম হয়েছিল দিল্লিতে। এই সম্মেলনে কাছাড় থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। এই ধারার শীর্ষ নেতা ছিলেন হুরমত আলি বড় লস্কর, রাশীদ আলি, হাইলাকান্দির আবদুল মতলিব মজুমদার। দেশভাগের সময় তাঁর একক নেতৃত্বেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও তৎকালীন হাইলাকান্দি মহকুমা ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জন্যে কুখ্যাত। শিলচরের ইতিহাসে সেদিনটি গৌরবের। জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃত্বের উদ্যোগে সেদিন এক বিশাল মিছিলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা আওয়াজ তুলেছিলেন, হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, পাকিস্তান নয়, স্বাধীন অখণ্ড ভারত চাই। এই শহরের সদরঘাটে থাকতেন নেতাজির অনুগামী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা ও চরম মুসলিম লিগ বিরোধী গোলাম সবির খান। এই শহরেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বামপন্থী ছাত্রনেতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন মহীতোষ পুরকায়স্থ ও তারাপদ ভট্টাচার্য যারা পরবর্তী জীবনে কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না।

 

বাঁদিক থেকে গোপেন রায়, অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, দিগেন দাশগুপ্ত, রুক্মিণী আচার্য।

আন্দামানে অন্তরীণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথেও সম্পর্কিত হয়ে আছে এই শহর। বিপ্লবী বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ ঘোষের সহযোগী উল্লাসকর দত্ত শেষ জীবনে এই শহরেই থাকতেন। দেশ স্বাধীন না হলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন তিনি প্রণয়িনীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন লীলা নাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। আন্দামানের সেলুলার জেলের অত্যাচারে উল্লাসকর অপ্রকৃতিস্থ। অধ্যাপক সুখময় ভট্টাচার্যের উদ্যোগে তাঁর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়। পাশের রাস্তারও নামকরণ হয় তাঁর নামে। এই শহরের আরেক আন্দামান দ্বীপান্তরী গোপেন রায় ছিলেন মূলত হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ অঞ্চলের মানুষ। উমেদ নগর মেল ডাকাতির মামলায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্দামানে নির্বাসিত হন। আন্দামানে থাকাকালীন তিনি সহযোগী বন্দীদের গোষ্ঠী নারায়ণ রায়ের নেতৃত্বাধীন ‘কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন’ এ যোগ দিয়ে মার্ক্সবাদী আদর্শে দীক্ষিত হন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে গোলটেবিল বৈঠকের শর্ত অনুযায়ী আন্দামানের সমস্ত বন্দীদের পর্যায়ক্রমে মুক্তি দেওয়া হলে গোপেন রায় সিলেটে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। মুক্তি পেয়ে যেদিন তিনি সিলেটে ফেরেন সেদিনই শিলচর থেকে অচিন্ত্য ভট্টাচার্য সিলেট গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে কাছাড় জেলাকে রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র করার অনুরোধ জানান। দুজনের যখন দেখা হয় তখনও জেল ফেরৎ গোপেন রায় বাড়ি যান নি। বাড়ির বাইরে ধানখেতের আলে বসে দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি কাছাড়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। বাড়িতে একটি বারের জন্য ঢুকেই অচিন্ত্য ভট্টাচার্যের সাথে শিলচরে চলে আসেন। সেই থেকে আমৃত্যু দলের কার্যালয়ে অত্যন্ত সাধারণ জীবন ধারণ করে থাকতেন তিনি। আরেক বিপ্লবী দিগেন দাশগুপ্ত ছিলেন সিলেটের আজমিরীগঞ্জ মেল ডাকাতির অধিনায়ক। পরবর্তীতে তিনি কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর তিনিও ছিলেন এই শহরের বাসিন্দা। আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে। সিলেটের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী, প্রথম জীবনে কংগ্রেস কর্মী ও পরবর্তীকালের কমিউনিস্ট ভূপতি চক্রবর্তী ছিলেন এই শহরেই। আইন অমান্য আন্দোলনে পুলিশের অত্যাচারে তিনি চিরদিনের মত ন্যুব্জ হয়ে যান। এভাবেই এই শহরে পার্টির খবরের কাগজ বিলি করেছেন আমৃত্যু।

ইরাবত সিং।

মনিপুরের অবিসংবাদী জাতীয়তাবাদী নেতা ইরাবত সিংহ সিলেট জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মনিপুরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার জন্যে কাছাড়ে আসেন। সিলেট জেলে সহবন্দী অচিন্ত্য ভট্টাচার্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত হন। তিনি কাছাড়ে থাকাকালীন কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও। আধুনিক মনিপুরের নৃত্য, নাটক, সাংবাদিকতা, গীত রচনা- সমস্ত কিছুতেই তিনি ছিলেন অগ্রণী। তাঁর সাংগঠনিক নেতৃত্বেই কাছাড়ের নানা জনগোষ্ঠীর কৃষক সমাজ স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।

এই শহর বা অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এক বিশাল অধ্যায়। একটি ছোট্ট নিবন্ধের পরিসরে তাকে ধরা অসম্ভব। আমি শুধু নিজের সামান্য জানাকে আজকের প্রজন্মের খাতিরে লিপিবদ্ধ করলাম। সরকার যদি না-ও উদ্যোগ নেয় সাধারণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে পারিবারিক স্তর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাসের চর্চা শুরু হতে পারে। তবে শুধু ব্যক্তি বা ঘটনার ইতিহাস নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শেরও চর্চা হওয়া জরুরি। নয়ত কতগুলি নির্বাচিত প্রতীক নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধের বিপরীত মেরুতেও চলে যেতে পারি। সেটা পরাধীনতার চেয়ে কম কলঙ্কের হবে না।

শেষ করব, দুটো বেসুরো প্রসঙ্গ দিয়ে। এই শহরে শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, ব্রিটিশ আনুগত্য প্রকাশেরও বিচিত্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইংল্যান্ডের রাজার ভারত আগমন উপলক্ষ্যে শহরের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক অত্যুৎসাহে বাড়ির সামনে আলোকসজ্জা করেছিলেন। শহরের এক প্রবীণের মুখে গল্পটি শোনা। ওই চিকিৎসকের আশা ছিল, ঔপনিবেশিক শাসকরা তার রাজানুগত্যে খুশি হয়ে তাকে হয়ত রায়বাহাদুর উপাধি দেবে। শহরের মানুষ হয়ত এই রাজানুগত্যে অসন্তুষ্ট হয়েছিল। ফলে তার রায়বাহাদুর লাভের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যঙ্গ করতেই নাকি কারা বাড়ির সামনে মরা বাদুড় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এ সবই শোনা কথা।

আগে এই অঞ্চলের মুসলিম লিগ নেতাদের নাম বলেছি। তবে শুনেছি এই শহরের এক বিশিষ্ট মুসলিম লিগ নেতা ছিলেন একজন অ-মুসলিম ব্যবহারজীবী। যিনি নাকি ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট শিলচরে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরবর্তীতে পদবী পরিবর্তন করা তাঁর পুত্র অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর রাজনীতির নেতা হয়ে এই শহরের এক বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

এক কথায় বলা যায়, এ শহরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস শুধু বিশাল নয়, চিত্তাকর্ষকও।

Comments are closed.