Also read in

প্রকাশ-রাজুদের এমন অবস্থার জন্য দায়ী গোটা সিস্টেম !

রাজ্য দলের দুই ক্রিকেটার প্রকাশ ভগত ও রাজু দাসের করুণ অবস্থা জানার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ক্রীড়ামহল। আসলে শুধু স্থানীয় ক্রীড়ামহল নয়, গোটা দেশ থেকে আমাদের কাছে এনিয়ে প্রতিক্রিয়া এসেছে। বিশেষ করে রনজি তারকা প্রকাশের করুন অবস্থার কথা জানার পর গোটা দেশ থেকেই প্রতিক্রিয়া আসছে। এমনকি বিদেশ থেকেও লোকেরা আমাদের কাছে প্রকাশের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাকে সাহায্য করতে চাইছেন। উল্লেখ্য, আর্থিক অভাবে বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে ডালপুরি দোকান চালাচ্ছেন রনজি তারকা প্রকাশ। অন্যদিকে কোনো সরকারি চাকরি না পেয়ে এক গ্যাস এজেন্সির ডেলিভারি বয়ের চাকরি করছেন রাজু। বরাক বুলেটিন-ই প্রথমে এই দুটি খবর তুলে ধরেছিল। আর দুটি খবরই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে প্রকাশের খবরে তো বিদেশ থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। খবরটা ইতিমধ্যেই ভাইরাল। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এখনো সেই একই জায়গায় রয়ে গেছেন প্রকাশ ও রাজু। খবর দুটি ব্যাপক সাড়া জাগালেও এখনো একটা চাকরি জোটেনি রাজ্য দলের দুই ক্রিকেটার এর। যদিও প্রকাশের খোঁজখবর নিয়ে গেছে ডিরেক্টর অব স্পোর্টস কার্যালয়। বাঁহাতি তারকাকে তার বায়োডাটাও জমা করতে বলা হয়েছে কার্যালয়ের পক্ষ থেকে। আর ইতিমধ্যে প্রকাশ তা জমা দিয়েছেন।

এখানে প্রশ্ন উঠছে এর আগে কেন এ বিষয়ে টনক নড়লো না ডিরেক্টর অব স্পোর্টস কার্যালয়ের? বরাক বুলেটিনের খবরের পর এখন অনেকেই প্রকাশকে এককালীন কিছু একটা অর্থ দিয়ে নাম কুড়োতে চাইছেন। সেই সঙ্গে দিচ্ছেন একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতিও। এতদিন কোথায় ছিলেন সেইসব ‘দরদিরা’ ? এই মুহূর্তে প্রকাশ যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাতে এককালীন অর্থ সমস্যার সমাধান নয়। ‌তার চাই একটা স্থায়ী চাকরি। রাজুর ও দরকার একটা ভাল চাকরির। কিন্তু কে শুনবে এদের কথা? প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো শিলচরের দুই তারকা ক্রিকেটার কে।

এমন অনেকেই রয়েছেন যারা রাজ্য দলের জার্সি গায়ে এক ম্যাচ খেলেই সরকারি চাকরি পেয়ে গেছেন। আজ সেই সব ক্রিকেটাররা প্রতিষ্ঠিত। তাহলে রাজু ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এমনটা হলো না কেন? এজন্য দায়ী কিন্তু আমাদের এই সিস্টেম। প্রকাশ তো টানা খেলে গেছেন রাজ্য দলে। রাজ্যের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে গেছেন। ট্র্যাক রেকর্ডই তার হয়ে কথা বলছে। ‌ তবে এমন একটা প্রোফাইল থাকা সত্ত্বেও আজ রাস্তার পাশে ডালপুরি বিক্রি করতে হচ্ছে প্রকাশকে। এর দায় কার? প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই একটা পিক টাইম থাকে। প্রকাশের ক্ষেত্রে সেটা ছিল ২০০৮-২০১২। বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সহ রনজি ট্রফিতে ও রাজ্য দলের জার্সি গায়ে ধারাবাহিক পারফর্মার ছিলেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সেই সময় আসামের ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন অজিত সিং। তিনি আবার প্রকাশের পাড়ার লোক। তারপরও প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারলেন না? এ নিয়ে প্রাক্তন মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই সময় স্পোর্টসে তেমন ফান্ড ছিল না। তবুও আমি চেষ্টা করেছি।’ ব্যাস, এটুকুই? এক সূত্র অনুসারে, প্রকাশকে নাকি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রাক্তন ক্রীড়া মন্ত্রী অজিত সিং। কিন্তু সেটা শুধু প্রতিশ্রুতিই থেকে গিয়েছিল।

শিলচর জেলা ক্রীড়া সংস্থার বর্তমান কর্ম সমিতি দায়িত্ব নেওয়ার পর সচিব বিজেন্দ্র প্রসাদ সিং প্লেয়ার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড করেছেন। যা দিয়ে বেশ কয়েকজন প্রাক্তন খেলোয়াড় কে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। একবার খুবই অসুস্থ ছিলেন প্রকাশ। তাকেও এই ফান্ডের মাধ্যমে আর্থিকভাবে মদত করা হয়েছিল। জেলা ক্রীড়া সংস্থা খেলোয়াড়দের চাকরি দিতে পারেনা। ‌ এই ক্ষমতা তাদের নেই। তবে রাজ্য দলের প্রতিনিধিত্ব করা খেলোয়াড়দের জন্য সুপারিশ তো করতে পারে। প্রকাশ যখন টানা রাজ্য দলের হয়ে খেলছিলেন তখন কি সংস্থা তার চাকরির জন্য কোনো সুপারিশ করেছিল? সেই সময় সংস্থার সচিব পদে ছিলেন বাবুল হোড়। যিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গেও যুক্ত। ভারতীয় এ দলের ম্যানেজার হিসেবে নিউজিল্যান্ড সফরেও গেছেন। এতসবের পর ও কেন একটা চাকরির জুটলো না প্রকাশের?

আমাদের ক্রীড়া সংগঠকদের কাছে তাদের সাফল্য জানতে চাইলে তারা দীর্ঘ তালিকা তুলে ধরেন। ‘অমুক দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তমুক দল রানার্স হয়েছিল আমার দায়িত্ব কালে।’ এটাই হচ্ছে এখানকার অধিকাংশ সংগঠকদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে যদি তাদের প্রশ্ন করা হয়, আপনি দায়িত্বে থাকাকালীন কজন খেলোয়াড় উঠে এসেছে? অথবা খেলোয়াড় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকা কি ছিল? তখন দেখবেন তাদের সেই দীর্ঘ তালিকা উদাও হয়ে গেছে। তখন শুরু হয়ে যাবে ক্রেডিট নেওয়ার পালা। এমনটাই হয়ে থাকে। আর এমনটাই হয়ে আসছে। অথচ আজকের দিনেও এমন সংগঠকরা রয়েছেন যারা পর্দার আড়ালে খেলোয়ার তৈরি করছেন। কিন্তু লাইম লাইটে আসছেন না। অথবা তাদের আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ তাদের সেই পরিশ্রমের সব ক্রেডিট নিয়ে নিচ্ছেন হেভিওয়েট সংগঠকরা।

প্রকাশের নেতৃত্বে প্রথমবার সিনিয়র আন্তঃজেলা নুরুদ্দিন ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল শিলচর। অনেক সংগঠকই এই সাফল্যে কৃতিত্ব নিয়ে থাকেন। তাহলে তারা কি এবার প্রকাশের এই করুন অবস্থার দায়ভার নেবেন? প্রশ্ন উঠবে সরকারের ভূমিকা নিয়েও। কেন তখন স্থানীয় সাংসদ ও বিধায়ক এ বিষয়ে সক্রিয় হলেন না? রাজ্য সরকারের কাছে প্রকাশের একটি চাকরির জন্য আর্জি জানালেন না। এটা শুধু আগের সরকারের কথা নয়, বর্তমান রাজ্য সরকার ও কেন রাজ্য দলের তারকা প্রকাশকে একটা চাকরি দিল না? প্রকাশকে নিয়ে সবাই শুধু ক্রেডিট নিয়েছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে কেউই ছেলেটার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। না হলে রাজ্য দলে ভালো পারফর্ম করার পর তাঁকে সংবর্ধনা সভায় চাকুরীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কেন তা পালন করা হলো না? নাকি শুধু ক্রেডিট নেওয়ার জন্য ছিল সেই সংবর্ধনা সভা? সেই সময় প্রকাশ প্রতিটি সরকারি কার্যালয় চাকুরীর জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। অথচ রাজ্যের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যখন দেখা গেছে রাজ্য দলের হয়ে এক ম্যাচ খেলেই একজন সরকারি চাকরি পেয়ে গেছেন। সেটার জন্য তাকে তেমন দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি। তাহলে প্রকাশের ক্ষেত্রে কেন এমনটা হল না? এজন্য কি তখনকার ক্রীড়া সংগঠকরা দায়ী নন? শিলচরের ছেলে হওয়ার জন্যই কি মাশুল গুনতে হলো প্রকাশকে? বরাক সবসময়ই বঞ্চিত। সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত। বিশেষ করে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার বরাক ব্রহ্মপুত্র মেলবন্ধনের কথা জোর গলায় বলে থাকে। তবে এটা সত্যি কারের অর্থে তখনই প্রমাণ হবে যখন প্রকাশ- রাজুর মত শিলচরের ছেলেদের কপালে সরকারি চাকরি জুটবে।

Comments are closed.