Also read in

A special feature on the birth anniversary of nobel laureate Rabindranath Tagore

আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ

বাঙালির মনে শ্রেষ্ঠ কবির প্রতিচ্ছবিতে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন অনন্তকাল ধরে! বাঙালি গান জানে আর রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেনা- এমন ভাবনা অদ্ভুত! যারা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে জানে না, তারা শুনে তৃপ্ত হয়! যারা আবৃত্তি করতে জানে না,তারা কবিতা পাঠ করে আনন্দ পায়! তাই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালির জীবন অসম্পূর্ণ। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন আমাদের এই প্রাণের কবি।রবীন্দ্রনাথ আমাদের রক্তে, আমাদের মজ্জায়, আমাদের মস্তিষ্কে, আমাদের মননে, আমাদের হৃদয় সিংহাসনে।বসে আছেন হৃদয় জুড়ে, আলো করে। কারোর কাছে রবীন্দ্রনাথ কবি। কারোর জীবনে প্রাণের মানুষ। কেউবা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে প্রাণের সঞ্জীবনী খুঁজে পান। কারোর কাছে তিনি পরম বন্ধু। কেউবা এই প্রাণের কবির হাত ধরে পৌঁছে যান কল্পনায় মাখা স্বপ্নের জগতে।কারোর দুঃখের চরম মুহুর্তে মনের গভীরে সান্তনার হাত রাখেন রবীন্দ্রনাথ। কাউকে বা জীবনের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন বিশ্বকবি।চলুন জেনে নেই, কার চোখে কেমন ধরা দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

সুদীপ্তা সেনগুপ্ত, শিক্ষিকা

আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ এক অপার বিস্ময়, এক অথৈ সাগর,এক প্রেমিক পুরুষ,আমার নিভৃত প্রাণের দেবতা।

ছোটবেলায় সেই লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা লোকটি ছিলেন আমার ‘রবি দাদু’ যিনি যখন তখন পড়া থেকে বা খেলা থেকে সরিয়ে আমাকে নিয়ে চলে যেতেন সুদূর তেপান্তরের মাঠে বা গাঁয়ের ছোট নদী বা পুকুর পাড়ে,দেখিয়ে আনতেন গরুর গাড়ি,তালগাছ,সোনালী পাকা ধান আরও কত,আর শোনাতেন অনেক ছড়া ও কবিতা ।’শিশু ভোলানাথ’ এর কবিতা শুনতে খুব ভালো লাগতো,কেমন যেন এক মায়া ভরা সুর ছিল তাতে, চট করে মুখস্থ হয়ে যেত,বেশ হাততালিও জুটত কপালে,যেন দাদু নিজে কিনে চকোলেট খাওয়াতেন।যখন একটু বুঝতে শিখলাম তখন অসুস্থ অমলের বন্দীদশা বা মাতৃহারা সেই শিশুটির চেনা গন্ধের মধ্যে মাকে খুঁজে ফেরা, এসব চোখে জল এনে দিত, কিন্তু তখনই রবি দাদু স্নেহভরে কোলে নিয়ে সাজিয়ে দিতেন বীরপুরুষ এর সাজে, মাকে নিয়ে একা দূরে সাহসী অভিযানে পাড়ি দেওয়া আর বীরত্ব দেখিয়ে মায়ের ভরসা ও আদর লাভ করার কথা ভেবেই মন পুলকিত হয়ে উঠত।আমি যত বড় হতে লাগলাম,দাদু যেন ততই ছোট হতে লাগলেন,তিনি তখন রবীন্দ্রনাথ, সৌম্যদর্শন এক পুরুষ যিনি জাদুকরের মত একাধারে কবি,গল্পকার,ঔপন্যাসিক,নাট্যকার,চিত্রকার আবার সংগীত স্রষ্টা।আমি তখন যেন সেই ‘ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষন্ন তরুচ্ছায়ে ‘বাঁশি বাজিয়ে যেতাম,এ বাঁশি প্রাণের বাঁশি, এ বাঁশির নামই রবীন্দ্রনাথ,আমি যেমন তাকে বাজিয়ে যেতাম নিভৃতে- নিরালায়,ক্ষণে-অনুক্ষনে, তিনিও তেমনি কানায় কানায় ভরে দিতেন গানের সুর।যৌবনে তিনি প্রকৃত অর্থেই আমার দোসর,যিনি শুধু সঙ্গই দেন নি ,দিয়েছেন আসঙ্গ।যে কথা কাউকে বলা যায় না,অনায়াসে তাঁকে যায় বলা,জীবনের প্রতিটি আবেগ,অনুভূতি ,সুখ দুঃখ,হাসি কান্না,সব তাঁকে সমর্পন করলে তাঁর কথার ব্যঞ্জনায়, তাঁর সুরের মূর্ছনায়, সে হয়ে উঠে পরম সুন্দর,সে এক পরম প্রাপ্তি,এক চরম শান্তি।জীবনের সবচাইতে সুন্দর যে অনুভূতি,প্রেম,তাকেও চিনেছি,জেনেছি ও দেখেছি তার চোখে,তার সাথে।সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমি কখনো লাবণ্য,কখনো বিমলা,কখনো বিনোদিনী, কখনো গ্রামের মালতী, আবার কখনো এলা।আজ কিন্তু তিনি শুধু দোসর নন,রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজা যেমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত,যেমন তারা একে অপরের পরিপূরক,তেমনি আমার দোসর আজ আমার দেবতা।আজ এই নিভৃত প্রানের দেবতাকে আমিও বলি সীমার মাঝে অসীম তুমি,বাজাও আপন সুর,সে সুরে বুঝি মরণ থেকেও জেগে উঠব আমি,আমার ভিতরের সত্বা যার কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রিয়তম বা অন্তরতর নন,তিনি সত্যদ্রষ্টা, তিনি ঈশ্বর।’ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি,তোমায় প্রণাম,তোমায় প্রণাম শতবার।।

শান্তা দেব, প্রোগ্রাম এক্সেকিউটিভ (নিউজ), দূরদর্শন কেন্দ্র, কলকাতা

আমার রবীন্দ্রনাথ একজন সার্বিক রবীন্দ্রনাথ।যিনি গানকে দেখছেন তার জীবন দিয়ে।একটি মানুষের জীবনের যত রকমের ছোট ছোট অনুভূতি হতে পারে,তা সব তার গানে ছবির মতো ধরা পড়ে। তিনি এমন ভাবে সমস্ত কিছু  নিয়ে জড়িয়ে আছেন,যে তাকে টপকে বা উল্লোঙ্ঘণ করে অন্য কোথাও যাবার উপায় নেই।আর তাই হয়ত আজও এতবছর পরেও তিনি চির নূতন। একজন শিল্পী বা সৃষ্টিশীল মানুষের মনের মধ্যে একটি কল্পনার জগত থাকে। এই বস্তু জগতে হয়তবা তার কোন অস্তিত্বই নেই।রবীন্দ্রনাথের গানে সেই কল্পনার জগতের দ্বার খুলে যায় আপনিতেই।আমার মনে হয় আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশবিশেষ একটি সূতোয় গাঁথা।আর সেই অদৃশ্য সূতোর অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই কবিগুরুর গানে।আজ থেকে পনেরো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের গান যেভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম,এখন যত বয়স বাড়ছে তার অবস্থান যেন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ব্যক্ত করেছেন তার গানের মাধ্যমে।তার গান আমার জীবনের আনন্দের মুহূর্ত গুলোকে যেমন সুন্দর করে উপভোগ করতে শেখায় তেমনি কঠিন সংকটে বেঁচে থাকার সাহস যোগায়। “আমি তোমার সঙ্গে বেধেঁছি আমার প্রাণ সুরেরো বাঁধনে। ”

কবিতা সেনগুপ্ত, অধ্যক্ষা, পাবলিক উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিলচর

‘আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ’এই কথাটি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে “সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি, সেই তো আমার তুমি।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পথ চলার সঙ্গী,এক অভ্রান্ত প্রবাহমান কাল তাঁকে নিয়ে পাওয়া, তিনি যেন আমাদের সব মনের কথা গুলো বলে দেন। এক অপরিসীম ব্যাপ্তি, বাংলা ভাষার প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথ এক অজেয় অন্তহীন শক্তি। তিনি কত অবলীলায় গেয়ে ওঠেন”আমি মারের সাগর পাড়ি দেব….”।সংকট ,সংশয়,বিষাদ, আনন্দ, বিশ্বাস, প্রতিদিনের জীবনের বোঝাপড়া তাঁর সৃষ্টিতে মিলেমিশে একাকার। তিনি যেন বহমান সভ্যতার ধারা। তাঁর সুক্ষ রুচিবোধ, তুচ্ছতার মধ্যে অনাবিষ্কৃত একটি সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া, বিপদসংকুল পথের শেষে আলোর সঞ্জীবনী রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন”তাই তোমার আনন্দ আমার পর….” কখনও “নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে…”। তিনি কখনও সমাজ সংস্কারক, গীতিকার, প্রাবন্ধিক আবার একাধারে প্রকৃতি বিজ্ঞানী, বিশ্বকবি সব যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী,এক অপূর্ব স্বর্গীয় সান্ত্বনা। বিশ্বকবি আমাদের উত্তরণের মন্ত্র দিয়ে গেছেন, বিশ্বাস ও সমর্পণ মানুষকে উন্নতির সেই শিখরে পৌঁছে দেয় যেখান থেকে পৃথিবীকে স্বর্গ মনে হয়। তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অদ্ভুত ধৈর্য্যের নিদর্শন, ছিল অনেক কৃচ্ছসাধন এবং প্রত্যাখানেও অপূর্ব রুচির পরিচয় “এ মণিহার আমায় নাহি সাজে….”।এ আলোচনা শেষ হবার নয় তাই কবিগুরুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে এটুকুই বলতে পারি সেই ছোট্ট বেলায় সহজপাঠে তোমার সাথে পরিচয় , তারপর ক্ষুদ্র আমি বারংবার জীবনের প্রতিটি অনুভূতিতেই আমার সঙ্গী তুমি বিশ্বকবি।

বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য, গীতিকার-লেখক

আমার রবীন্দ্রনাথ আমার মতই। ভবঘুরে। অগোছালো। গান ভালবাসেন। বই পড়তে ভালবাসেন। খুব আড্ডা পাগল।
নিজের মত করে তাঁকে ভাবি। তিনি একেবারে আমার বন্ধুর মত। বুকের ‘নিভৃত নিকেতন’এ তিনি আছেন। মন খারাপের রাতে পাশে এসে বসেন। ভরসা দেন। সুখের সময় দুঃখ জয়ের মন্ত্র শেখান!

Comments are closed.