Also read in

A special piece by Aritra Dhar on the occasion of Rabindra Jayanti

আসমুদ্র হিমাচলে ঢেউ তোলা রবিবাউলের জন্মদিনে ছোট্ট শ্রদ্ধার্ঘ—

ভেবেছিলেন বিশ্বকবির জন্মদিনে এভাবে বন্দি হয়েই কাটাতে হবে? না কেউই ভাবেননি। আসলে করোনার উপদ্রবে দিশেহারা হয়ে পড়া সমাজ কোনদিনই ভাবেনি বাঙালির প্রাণ বিশ্ববরেণ্য রবিঠাকুরের জন্মদিনে এভাবে গৃহবন্দি হয়েই কাটাতে হবে। হ্যাঁ সকলেরই মত আমিও কিন্তু ভাবিনি। আসলে ছোটবেলা থেকেই ইনি আমার বড্ড প্রিয়। পাড়ার মঞ্চে বাবার হাত ধরে জীবনের প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম সেদিন। খুব যত্ন করে কবির ‘মাষ্টারবাবু’ শিখেছিলাম আর পাড়ায় মৌলভী রোড ও নেতাজী লেন ডেভেলাপমেন্ট কমিটি আয়োজিত বিজয়া পরবর্তী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেছিলাম কবিতাটা। তবে সেদিন আমার সাজ-পোশাক দেখে খানিকটা চমকেই উঠেছিলেন পাড়ার জ্যেঠু-কাকু-কাকিমারা। সেসময় কমিটির সম্পাদক ছিলেন মৃণ্ময় দত্ত ওরফে সাধু জ্যেঠু। শিলচর শহরের কাছে পরিচিত ছিলেন টাউন ক্লাবের সাধুদা নামেই। একদিন বাবার বলে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছিলাম ঠিক সেসময় বাড়ি আসেন কোন একটা কাজে, আর এসে দেখতে পান আমি আবৃত্তি করছি। কাজের কথা ভুলেই যান সেদিন তিনি। বসে পড়েন আমার কবিতা আওড়ানো দেখতে। ঠিক সে মূহুর্তে বাবার প্রতি তাঁর অভিভাবন…. আমাকে নাকি সাজিয়ে তুলতে হবে স্টেজে। ব্যস যেমন কথা তেমন কাজ। দিনক্ষণ ঘনিয়ে এল। প্রতিদিনই পাড়ায় রিহার্সাল হত। প্রতিদিনই ঘড়ঘড় করে কবিতা আওড়াতাম কিন্তু কেউই বুঝতে পারেননি সেদিন অনুষ্ঠানে ঠিক কি হতে চলেছে৷ অনুষ্ঠানের দিন আমার নাম ডাকা হল, সবাই অপেক্ষারত- কোথায় ছেলেটি? তখন অবধি আমি বাড়িতে। আসলে জীবনে প্রথম এমন সাজে আমি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছিলাম। সাজুগুজু শেষে আয়নায় তাকাতেই ধুতি পাঞ্জাবী আর চোখে হাইপাওয়ারের চশমায় সত্যি এক টিপিক্যাল মাষ্টারবাবুই লাগছিল। অবশেষে বাবার হাত ধরে খুঁড়োতে খুঁড়োতে গিয়ে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলাম শিলচরের বর্তমান বিধায়ক শ্রদ্ধেয় দিলীপ কাকুদের বাড়ির উঠোনে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে। সবাই হতবাক আমার এহেন সাজ-পোশাক দেখে৷ আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়… স্টেজে উঠে কবিতার ছন্দ ধরি……।

“আমি আজ কানাইমাস্টার, পড় মোর বেড়ালছানাটি।
আমি ওকে মারি নে মা, বেত,
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
পড়াতে দেয় না ও তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই
যত আমি বলি “শোন্‌ শোন্‌’।
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
লেখায় পড়ায় ভারি হেলা।
আমি বলি “চ ছ জ ঝ ঞ’,
ও কেবল বলে “মিয়োঁ মিয়োঁ’।”

সেই অনুষ্ঠানের তোলা ছবি দেখলে আজও মনে ভেসে ওঠে সেসব ফেলে আসা স্মৃতির রেশ। তারপর আর কিছুই মনে নেই। ধীরলয়ে দুর্গাশঙ্কর পাঠশালার বারান্দা অতিক্রম করে অধরচাঁদ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ। একবছর বাদে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন বিদ্যালয়ের নবনির্মাণ শ্রেণীকক্ষের উদ্ধোধনে সেদিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন কেন্দ্রীয় ভারীশিল্প মন্ত্রী প্রয়াত সন্তোষমোহন দেব মহাশয়। আমাদের একটা ছোট্ট গানের দল গড়ে ওঠে। অগ্রজদের মাঝে গায়ক মেঘরাজ চক্রবর্তী, দেবোদীপ চৌধুরী, তবলায় অঙ্কন কংসবণিক, অনুজপ্রতিমদের মাঝে বিশ্বদিব্য বিশ্বাস, সহপাঠীদের মাঝে নীলকমল ভট্টাচার্য। তবে গায়ক না হলেও সেদিন সে মঞ্চে আমার স্থান হয়েছিল শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয়া অপর্ণা দেব ও স্নিগ্ধা চট্টোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। মুক্ত কণ্ঠে সেদিন আমরা গান ধরেছিলাম
“আলোকেরই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও…..”
ব্যস সেই শুরু। ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হোক গান, হোক কবিতা সেই দলের পারফরম্যান্স থাকতই। এভাবেই আমার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন বিশ্বকবি। তবে সেসব স্মৃতি ভুলতে পারতাম না। স্কুল-কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে এলেও অধরচাঁদের সেই অসাধারণ স্মৃতির রেশ ভুলে যাওয়া বড্ডই কষ্টকর ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দিয়েও প্রতিবছর নিয়ম করেই বিদ্যালয়ের কবিপ্রণামে একটিবার হলেও ঢুঁ মারতাম আমি আর নীলকমল। ও হ্যাঁ, নীলকমল নাম হয়ত অনেকের কাছে অজানা কিন্তু ওর অগ্রজপ্রতিম ভ্রাতা নীলোৎপল ভট্টাচার্যের কথা না জানা মানুষ এ শহরে হয়ত কমই আছেন।

গতবছর নীলকমল শান্তিনিকেতনে থাকায় আসতে পারেনি। তবে কথা ছিল এবছর নিশ্চয়ই আসবে। একটা প্ল্যান করেছিল সে। যেহেতু বন্ধু এবারে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে জমিয়ে কবিপ্রণাম হবে আর সে অনুষ্ঠানে মজবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা৷ কিন্তু হায় বিধি বাম। রবিবাউলের ১৬৯তম জন্মদিবসে উদযাপন নয়, বরং করোনার আক্রমণে ঘরবন্দি হয়েই কাটাতে হচ্ছে আমাদের। তাই কবিগুরুর শ্রীচরণে ঘরবন্দি শ্রদ্ধার্ঘ রইল আমার…..
” হে গুরুদেব বিশ্বকবি তোমার মধুর সুরের গান,
আজও দুনিয়া নিচ্ছে টেনে তুলছে কত অমৃত তান।
বাঙালি তথা ভারতবাসীর গৌরব তুমি হে গুরু,
তোমার গান না শুনে মোর দিন হয় না যে শুরু ।।
ভারত বাংলা শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাজে যে গান,
প্রাণের সেই জাতীয় সঙ্গীতের তুমিই দিলে প্রাণ ।
বাংলার মাটি গেয়ে ওঠে আজ মহামানবের জয়গান,
সারাটা বিশ্ব মাথা পেতে বলে আজো আছ মহান ।।
জনমে মরণে তুমি হে গুরু ভরসা যুগিয়ে যাও,
গানে-সুরে-তানে-ছন্দে-লয়ে ওই প্রাণের বীণা বাজাও ।
জানালাতে দাড়িয়ে দেখছিলে তুমি টাপুর-টুপুর বৃষ্টি,
প্রথম কবিতাই জানান দিল এযে ভবিষ্যতের জন্য সৃষ্টি ।।
ও হো কেমনে ভুলি সেই কবিতা কোনো বাঙালি ভুলে না,
‘জল পড়ে,পাতা নড়ে’ প্রথম কবিতা আর তো থামলে না ।
বাঙলাকে আর বাঙালিকে ভালবেসে লিখলে প্রাণের গান,
তাই দিয়েই আজো বাঙালি তুলছে সুরের হুঙ্কারো বাণ ।
বাঙালিকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা দিতে তোমার অনেক অবদান,
নীরবে নিভৃতে তাই শুনি ঘরে বসে ‘২৫শে’র সেই অমর গান।।”

হে বিশ্বকবি তোমার কালজয়ী ভালবাসার সাতরঙা সুরের ভেলায় ভাসতে থাকুক প্রতিটি প্রেমিক হৃদয়। তোমার সুরের রঙে প্রতিদিন হোক রবীন্দ্র জয়ন্তী। প্রণাম গুরুদেব।।

Comments are closed.