Also read in

A Special writeup on the occasion of International Women's Day

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এক নারীর পাঁচমেশালি ভাবনা

British Novelist, Playwright, poet, Nobel laureate & Booker Prize winner   William Golding লিখেছেন

“I think women are foolish to pretend they are equal to men. They are far superior and always have been. Whatever you give a woman, she will make greater. If you give her a house, she will give you a home. If you give her groceries, she will give you a meal. If you give her a smile, she will give you her heart. If you give her sperm, she will give you a baby. She multiplies and enlarges what is given to her……”

এই অপূর্ব সুন্দর লাইন ক’টা নিজের মনে আওড়াতে গিয়ে চোখের সামনে অনেকগুলো ছবির সমাবেশ। আসলে আজ হোয়াটসঅ্যাপ ভাসছে ওমেন্স ডে অর্থাৎ বিশ্ব নারী দিবসের শুভেচ্ছা বাণীর জোয়ারে। অসংখ্য বারের মত আজও মনের কোণে একটা প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় জায়গা করে বসে আছে, শুধু এই নির্দিষ্ট দিনেই কেন মেয়েদের নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, এত আদিখ্যেতা! মনের ভেতরের এক ‘আমি’ সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল, হ্যাঁ সত্যিই তো! প্রত্যেকদিন নয় কেন! মনের ভেতরের অন্য ‘আমি’ অর্থাৎ দ্বিতীয় ‘আমি’ মুখোমুখি দাঁড়ালো, হলোই বা একদিন, তবুতো মেয়েদের নিয়ে কিছু তো হচ্ছে! কিছু ভাবনা, কিছু কাজ, কিছু একটা! নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো নয়? দুই ‘আমি’তে তুমুল যুদ্ধ! বাইরে থেকে নিঃশব্দে দুই ‘আমি’র যুদ্ধ দেখছিলাম। আর যাচাই করছিলাম কার পাল্লা ভারি।

কথা নেই বার্তা নেই, মনটা নিজের খেয়ালে পৌঁছে গেল মেয়েবেলার এক অপরাহ্ন বেলায়। দুর্গেশ স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। জিওমেট্রি পড়াচ্ছিলেন। আমরা ছাত্র ছাত্রী সবমিলিয়ে আট জন। কঠিন একটা প্রবলেম দিয়ে বললেন, দেখি কে সবচেয়ে প্রথমে শুদ্ধভাবে করতে পারে? সবাই মেরুদন্ড সোজা করে বসে শুদ্ধভাবে অঙ্কটা কষতে মনোযোগী হলো। সেদিন আমার পাশে বসা সুতপা সবচেয়ে প্রথমে প্রবলেমটা সলভ করল। স্যার খুব খুশি হলেন। প্রশংসাও করলেন বিস্তর। সুতপা খুব খুশি। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে রজত টিপ্পনী কাটলো, স্যার যতই শুদ্ধ হোক অঙ্ক কিংবা যত তাড়াতাড়ি প্রবলেম সলভ হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তো হাতে উঠবে হাতা-খুন্তি, ঠেলতে হবে হেঁসেলই। কথাটা বলার সময় কি আত্মবিশ্বাস রজতের! চমকে উঠেছিলাম। বলা ভাল আঁতকে উঠেছিলাম।

সেই চমক আজও ভাঙ্গেনি। আজও কানের কাছে রজতের শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ, ব্যঙ্গাত্মক হাসির শব্দ।

দিও দ্বিতীয় ‘আমি’  একমুখ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালো। আজ মোটেই শুধু হাতা খুন্তি নাড়াচ্ছে না মেয়েরা, হেঁসেল ঠেলেই ওরা ক্লান্ত নয়। ওরা দৃশ্য দুহাত আর অদৃশ্য আট হাত নিয়ে কিনা করে চলেছে পৃথিবী জুড়ে!

বাইরের আমি দ্বিতীয় ‘আমি’র আত্মবিশ্বাসে অনেকটাই প্রণোদিত। ভাবলাম, ব্যক্তিগত জীবনেও আমাদের ঘরে কখনোই কাজটা ছেলে আর মেয়ের হিসেব করে বিভক্ত হয় না। কাজগুলো কখনোই স্বামী কিংবা স্ত্রীর কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। ঘরে এবং বাইরের কাজের ক্ষেত্রে দুজনেরই সমান অধিকার। বুঝলাম পাল্লাটা ভারি দ্বিতীয় ‘আমি’র দিকে।

প্রথম ‘আমি’ সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসল। সচেতন ভাবে মনে করিয়ে দিতে চাইল, এক্ষেত্রে ভারতীয় পরিসংখ্যান কি বলছে? অর্থাৎ কত শতাংশ ভারতীয় মহিলা স্বনির্ভর? কত শতাংশ মহিলা ঘরে-বাইরে দু’ ক্ষেত্রে কাজ করছে? প্রথম ‘আমি’ সেই সঙ্গে এটাও জানতে চাইল, যারাওবা ঘরে এবং বাইরে দুটোই সামলাচ্ছে, তাদের কত শতাংশ স্বামী ঘরের কাজে মেয়েদের সাহায্য করছে?

পরিসংখ্যানে যেতে ইচ্ছে হলো না।এক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থানে আমূল পরিবর্তন আসলেও পরিসংখ্যান নিয়ে কমবেশি আন্দাজ করার ক্ষমতা আমাদের সবার রয়েছে। গ্রাম ভিত্তিক ভারতবর্ষে গ্রাম গুলোর অবস্থাও আমাদের অজানা নয়। তবু মনে হল পথ দীর্ঘ হলেও পথ চলা তো শুরু হয়েছে!

হ্যাঁ, পথ চলা শুরু হয়েছে অনেকদিন! কানের কাছে ভেসে উঠলো আমার মায়ের কয়েকটা কথা। মা সবসময় বলতেন, মেয়েদের বিয়েটা যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি নিজের পায়ে দাঁড়ানো, স্বনির্ভর হয়ে ওঠা। পড়াশোনা শিখে মেয়েরা যদি আত্মনির্ভর এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হয়ে উঠে তাহলে শুধু নিজের মত করে বাঁচা নয়, অন্যরাও অসম্মান করার আগে দশ বার ভাববে। সংসারে নিজের কথার একটা দাম থাকবে। মায়ের কথাগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে সেদিন না ভাবলেও আজ বুঝি আমার মা কতটা আধুনিক ছিলেন। কোন নির্দিষ্ট দিনে নারী দিবস পালনের কথা আলাদাভাবে না ভাবলেও এই দিবস পালনের কারণ সার্থক হয়ে ওঠে এখানেই।

কিন্তু প্রথম ‘আমি’র দ্বিতীয় প্রশ্নটা আমাকে একটু ভাবিয়ে তুললো। নিজের বাড়িতে পরিস্থিতি যাই হোক, এখনও এমন কম স্বামী রয়েছেন যিনি স্ত্রীর সঙ্গে একই সময়ে অফিস থেকে ঘরে ঢুকে চায়ের জলটা গ্যাসে চাপান। বরং ফ্রেশ হয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে প্রত্যাশা করেন এক কাপ গরম চায়ের। এক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়নি এমন নয়, কিন্তু পরিবর্তনটা কত শতাংশকে স্পর্শ করেনি, সেটা ভাববার বিষয়!

কিছু দিন আগে শিলচরের বিশিষ্ট আইনজীবী বীথিকা আচার্যের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসা একটা তথ্য এতসব ভাবনার ফাঁকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছিলো। তথ্য অনুযায়ী, যে ঘর শিশুর আশ্রয় স্থল, সেখানেই তারা বেশি নির্যাতিত। যারাই সুস্থ মস্তিস্কের তাদেরকেই ভাবিয়ে তুলবে এ তথ্য! কাজেই যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা নিশ্চয়ই সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী নয়। যারা অসুস্থ থাকেন তাদেরকে শুশ্রূষা করে সুস্থ করতে হয় কিংবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয় অথবা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। নিশ্চয়ই রোগ এবং রোগী নিয়ে বসে থাকা উচিত নয়।

অথচ আমরা প্রায়শই রোগকে চাপা দিয়ে দেই, রোগীকে আড়াল করে রাখি। ভয়ে, লজ্জায়,  ঘৃণায়। মনে পড়ছে বান্ধবী তনুজার(পরিবর্তিত নাম) কথা। যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কথাগুলো বলছিল, তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওর চোখে পৃথিবীর সব ঘৃণা যেন বাসা বেঁধেছে। অথচ একইসঙ্গে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল মেয়েটি। ওর চোখে মুখে স্পষ্ট মেয়ে হওয়ার লজ্জা ফুটে উঠেছিল, লজ্জা ছিল ওর শারীরিক গঠন নিয়ে। এক বুক কষ্ট নিয়ে ওকে দেখছিলাম আর কিশোরী বয়সে ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠছিলাম। ঘটনাটা কিছুটা হলেও খোলসা করে বলতে হয়। আমার বান্ধবী তনুজা কোনো এক গ্রীষ্মের ছুটিতে মাসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। আম, কাঁঠাল খাওয়ার পাশাপাশি সবার সঙ্গে মজা করে কিছুটা দিন কাটিয়ে আসবে বলে। সবকিছু ভালই চলছিলো। এক সন্ধ্যায় মাসতুতো দাদা ওকে পাশে বসিয়ে এটা ওটা গল্প করছিল। দাদা হাতটা পিঠে রাখল, তনুজা সহজভাবে নিল ব্যাপারটা। দাদার হাতটা চঞ্চল হয়ে উঠল। কিশোরীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জেগে উঠলো। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল।এসবে প্রতিবাদ করার ভাষা শেখেনি তখনও সেই কিশোরীটি।তাও আবার দাদার বিরুদ্ধে! তবুও ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছিল কিশোরীটি। দাদা(??) টেনে বসিয়ে দিল পাশে। মুখে বলল, পালাচ্ছিস কেন? বস, দেখবি কি মজা!তোরও ভাল লাগবে!

তনুজা অনেক কষ্টে এক সময় ছাড়া পেয়ে দৌঁড়ে চলে এলো মাসির কাছে। কোলে মাথা রেখে খুব কাঁদলো। কিন্তু কান্নার আসল কারণটা বলতে পারল না! নকল কারণ হিসেবে বলল, মাকে খুব মনে পড়ছে! বাড়ি যেতে চায়!

সেদিন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল তনুজা।লজ্জায় অপমানে কাউকে বলতে পারেনি কথাটা। মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য অনেক সময় অনেক মেয়েরা আফসোস করে, দুঃখ করে। কিন্তু কেন? এটাতো নিছক একটা সত্য মাত্র, যাতে মেয়েদের নিজেদের কোনো হাত নেই। বরং যাতে মেয়েদের হাত রয়েছে সেই দিকটা নিয়ে ভাবা উচিত। শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কি করে নিজেকে শক্তিশালী করে তোলা যায়, সেটা নিয়ে ভাবলে বরং লাভ হয়।অথচ তনুজা এই বয়সেও ভেবেছে,ঘটনাটা বললে অনেক বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে। হয়তো ওকেই সবাই বকবে। হয়ত মাসির বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া লেগে যাবে। কত কি!!

আসলে মেয়েরা এইরকমই। নিজের কথা ভাবার আগে অন্যের কথা ভাবতে বসে। সময় অনেক পাল্টালেও আজও মেয়েরা প্রথমে অন্যের কথাই ভাবে। বেশিরভাগ ঘরের মেয়েরা সবার খাওয়া হলে যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই পেট ভরে নেয়। ভালো সবকিছু অন্যদের দিয়ে যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই হয়ে যায় তাদের। কিন্তু কেন এই আপোস? বরং এই আপোসে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে আমাদের সমাজের। মা ভালো থাকলেই এবং স্বাস্থ্যবতী হলেই সুসন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব! অন্যের খেয়াল রাখার মানে এই নয় যে নিজের খেয়াল রাখা যায় না।

আমার এই এলোমেলো ভাবনা চিন্তায় মনের গভীরের দুই ‘আমি’ লড়াই ভুলে আমার ভাবনায় নিজেদের জড়ালো।

আরও একটা কথা প্রায়সই বলা হয়, মেয়েদের নম্র হওয়া উচিত, মেয়েদের সহনশীল হতে হয়, কারণ অনেক কিছু সহ্য করতে হয় তাদের। এই অনেক কিছুর মধ্যে ন’ মাস ন’ দিন   সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে শিশুটিকে পৃথিবীর আলো দেখানো অন্যতম। সবাই বলবেন, এতো প্রকৃতির নিয়ম। আমিও তাই বলছি। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বলে মেয়েদের কষ্টটা কিন্তু কম হয় না। এবার সবাই বলবেন, এতে অন্যদের কিছু করার থাকে না। বুঝলাম। কিন্তু অসহনীয় প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে সদ্য জন্ম দেওয়া কন্যা সন্তানকে দূরে ঠেলে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য যখন মাকে দায়ী করা হয়, তখন কি বলবেন সবাই? অথচ কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে মা নয়, বাবাই দায়ী, একথাটাও কত শতাংশ ভারতীয় জানেন? তাই সময় অনেক পরিবর্তিত হলেও গ্রাম প্রধান ভারতবর্ষে এখনো মেয়েদের অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।

লিঙ্গ সমতার জন্য অনেকে সাহায্য করার দায়িত্বভারটা ছেলেদের হাতে তুলে দেন। ছেলেদেরই উচিত মেয়েদেরকে সাহায্য করা। ছেলেদের উচিত মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার তাদের হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু ছেলেদের কাছে কি গচ্ছিত রয়েছে মেয়েদের অধিকার?  তাই নিজেদের সম্মান নিয়ে যারা সচেতন সেই মেয়ে কিংবা নারীদের এই কথাগুলো মানতে বড্ড আপত্তি। তাদের বক্তব্য, মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার দেওয়ার ছেলেরা কে? বরং মেয়েদেরকে নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে। ব্যাপারটা অর্জন করার, কারো কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার নয়। তাই যতদিন মেয়েরা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে পারবে না কিংবা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে না, অধিকার অর্জন করতে শিখবে না, ততদিন ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের একটা তারিখ হয়েই রয়ে যাবে! ততদিন সুতপা যতই কঠিন অঙ্ক অবলীলায় কষে নিক, রজত পাশ থেকে টিপ্পনী কাটবেই। তনুজা ভাইয়ের হাতে নিপীড়িত হয়েও লজ্জায়, ঘৃণায় কিছু বলতে পারবে না।ফলে রোগের সংক্রমণ এবং রোগীর আস্পর্ধা বেড়েই চলবে।

আগেই উল্লেখ করেছি, আমার ভেতরের দুই ‘আমি’ অনেকক্ষণ ধরে শান্ত, কারণ তারা বুঝে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ নেই। বরং ৮ মার্চ কি করে সত্যিকার অর্থে নারী দিবস হয়ে উঠতে পারে সে নিয়ে ভাবলে লাভ হবে!

Comments are closed.