As doctors protest around the country against torture on healthcare officials, here is a special writeup
জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজে শিলচর সিভিল হাসপাতাল নিয়ে কিছুদিন আগের শেয়ার করা একটি ভিডিও হঠাৎ করে আবার চোখে পড়ল। ডাক্তার, নার্স, সাফাই কর্মী সবাই মিলে নজরুল গীতির সঙ্গে ধামাইল নৃত্যের মাধ্যমে রোগীদের সবাইকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করছিলেন আজকের এই কঠিন, অসহনীয় কোভিড পরিস্থিতিতে। গানের পেছন থেকে একজনের কণ্ঠ ভেসে আসছিল, আনন্দ করইন, আনন্দ করলে মন উৎফুল্ল থাকবো, তাইলে……। কথার অর্থ হল, মন উৎফুল্ল থাকলে কিংবা আনন্দে থাকলে আমরা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা আরো দৃঢ় ভাবে করতে পারব। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিংবা সবাইকে ভালো রাখতে ডাক্তার নার্সদের এহেন সৃজনশীল চেষ্টার দৃশ্যটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো বেশ কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা একটি ভিডিও’র। অনেক জন মিলে একজন ডাক্তারকে প্রচণ্ড বাজে ভাবে মারধোর করার দৃশ্য। আত্মজনের বিয়োগ কেউ সহ্য করতে পারে না। এরই যদি বহিঃপ্রকাশ হয় তবু বলতে হয়, বিয়োগের কারণ না বুঝে কিভাবে এ ধরনের আচরণ করা সম্ভব? তারপর সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে,অনেক পোস্ট হয়েছে, অনেক মন্তব্য করা হয়েছে এমন বর্বোরোচিত আচরণ নিয়ে। আমি সে ঘটনায় আর যেতে চাইছি না, কারণ আমার লেখার বিষয়টি সেই ঘটনা নয়। সামাজিক মাধ্যমে যখন ঘটনাটি নিয়ে হুলুস্থুল চলছিল, তখন আমার এক বান্ধবী সেই ভিডিওটি হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে শেয়ার করে। নিচে লেখে, দেখ্ বন্ধু, আমরা কোন বর্বর সমাজে বাস করছি? কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাকিরা তো সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে। কাল হয়তো আরেক জন ডাক্তারের উপর প্রহার হতে পারে,কোন বিশ্বাসে কাজ করবে ডাক্তাররা? ছেলে মেয়েকে আর ডাক্তার বানাবি, দেখ্? আমি কি ভুল করলাম মেয়েকে ডাক্তার বানিয়ে?
শেষের কথাটায় চমকে উঠলাম। মা হিসেবে ওর মনের যন্ত্রণা, কষ্ট, ভয়, আতঙ্ক যেন এই একটা বাক্যের মাধ্যমে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সত্যিই তো, আমরা অন্য মা’রা যখন নিজের ছেলেমেয়েদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছি না করোনার ভয়ে, ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত, তখন ডাক্তার নার্স কিংবা হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের মা’রা নিজের মনের ভয়টাকে জয় করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন তাদের সন্তানদের অন্যদের সুস্থ করে তুলতে। তাহলে তাদের প্রাপ্য কি এটা?
“ডাক্তার ভগবানের স্বরূপ” কথাটা নিয়ে বর্তমান যুগে হয়তো অনেকের মনে সংশয় থাকতে পারে। আসল তো প্রাইভেট প্র্যাকটিস, টাকার লোভ, সেবা ভাবের এখন বড় অভাব, শুধুই ব্যবসা…….এধরনের অনেক শব্দ কিংবা বাক্য সমষ্টি উঠে আসতে পারে এই কথাটির বিরুদ্ধাচরণে। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে এগুলো আংশিক সত্য কিংবা হয়তবা অনেক ক্ষেত্রে সত্যও! কিন্তু মহামারি কিংবা অতিমারির এই সময়ে এই চিকিৎসা কর্মীরাই আমাদের ভরসাস্থল। তাদের উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া আমাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই। ডাক্তারদের মধ্যে ভালো-মন্দ দুটোই থাকতে পারে, যেমন অন্য আরও অনেক পেশায় থাকে। কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই এই মুহূর্তে সবচাইতে বড় ঝুঁকি নিয়ে তারাই কাজ করছেন। তাদের এই কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে আমরা যদি শুধুই সমালোচনা করি, তাহলে তারা এই কঠিন পরিস্থিতিকে জয় করে কি করে অন্যদের ভালো রাখবেন? আমাদের কি এটা ভোলা উচিত, অন্যদের ভালো রাখতে ওরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বেরোচ্ছেন?
সেদিন ভ্যাকসিন নিতে হাসপাতালে বসে ছিলাম। কিছুটা সময় লাগবে জেনে সময় কাটাতে কথা বলছিলাম সেখানে উপস্থিত নার্সের সঙ্গে। সেও বোধ করি একা বসে কারোর সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব ছিল। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কথা চলছিল এটা ওটা নিয়ে। কথাপ্রসঙ্গে জানলাম, ওর একটি ছোট্ট মেয়ে রয়েছে। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে গেলে কলিংবেলের শব্দে দৌঁড়ে ছুটে আসে সেই মেয়েটি মায়ের কোলে চড়বে বলে! মনেপ্রাণে চাইলেও মা কিন্তু মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে পারে না। ছোট্ট মেয়েটি তো আর জানে না করোনা কি কিংবা মহামারির কি রূপ! সে পুরো দিনের শেষে মাকে চায়, জড়িয়ে ধরতে চায় তার মাকে, মায়ের বুকে মাথা রাখতে কান্নাকাটি জুড়ে।
“জানেন, কতদিন হলো মেয়েকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে শুতে পারিনি। কারণ আমাদের কত রোগীকে ঘাটতে হয়। যদি আমার মেয়ের কিছু হয়ে যায়?”
কথাগুলো বলার সময় ওর চোখে জল ছিল না। কারণ চোখের জল কিভাবে লুকোতে হয় এতদিনে ওরা শিখে গেছে। কিন্তু একজন মা হিসেবে ওর গলার স্বরের আকুতিটা আমাকে আঘাত করছিল। মনে হচ্ছিল শুধু সেই মা নার্সই নয়, সেই ছোট্ট মেয়েটাও ওর নিজের অজান্তে আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য কত বড় স্যাক্রিফাইস করছে!
আমার মুখে কোন ভাষা ছিল না ওকে উত্তরে বলার মত।
নিঃশব্দে শুনছিলাম নার্সের কথা। “আমাদের অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। যুদ্ধ করেছেন এই রোগের বিরুদ্ধে। সুস্থ হয়ে উঠে আবার হাতে তলোয়ার তুলে নিয়েছেন অন্যদের সুস্থ করে তুলতে।”
মুখে আমার কথা নেই। শুনছিলাম মন দিয়ে।
“জানেন, আমার কলিগ স্বাতী’র মা সারাদিন ঠাকুর ঘরে বসে থাকেন। প্রার্থনা করেন নিজের মেয়ের জন্য। বলেন, আমি তো ওকে হাসপাতালে যেতে নাও করতে পারবো না। ওকে ডাক্তার করে তুলেছি, অন্যদের সেবাতো করতেই হবে। আবার ভয়টাও ঝেরে ফেলতে পারছি না মন থেকে। তাই ঠাকুরই ভরসা।”
মুখ থেকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন বেরিয়ে এলো, “আপনাদের ভয় হয় না নিজেদের জন্য?”
“আমরা যদি নিজেদের জন্য ভয় পাই, তাহলে আপনাদের কি হবে?”
আমার ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই কথাগুলো সামনে বসা সেই নার্স নয়, প্রশ্নটা যেন আমার দিকে ছুঁড়ে দিল বিশ্বের সব নার্স, ডাক্তার, চিকিৎসা কর্মীরা। অথচ পান থেকে চুন খসলে আমরা হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেই। এটা বলার চেষ্টা করছি না যে সর্বক্ষেত্রে ওরা সঠিক। অনেক ক্ষেত্রেই ওদের দিকে আঙ্গুল তুলতে মানুষ বাধ্য হয়। কিন্তু ডাক্তাররাও যে মানুষ, সেটা আমরা ভুলে যাই। ওরাও ভয় পেতে পারে, ওরাও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারে, ওদেরও পরিবার রয়েছে, ওদেরও বাড়িতে উৎকণ্ঠায় মা বসে থাকেন, কখন নির্বিঘ্নে ছেলে কিংবা মেয়ে ঘরে ফিরবে, ওদেরও ভাই কিংবা বোন উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে, ওদেরও স্বামী কিংবা স্ত্রী ভয়ে প্রহর গুণছে।
তাছাড়া পিপিই কিট পরে দিনের পর দিন কোভিড রোগীদের নিয়ে কাজ করতে গেলে ডাক্তার কিংবা নার্সদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কোথায় থাকতে পারে সমাজের একজন হিসেবে আমাদেরও চিন্তা করা উচিত। রোগীরা যেমন কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, ডাক্তার-নার্সরাও যুদ্ধ করছেন রোগীকে ভালো করে তুলতে এবং নিজেদেরকে ভালো রাখতে। আমাদের সচেতন থাকা খুব প্রয়োজন, কিন্তু তথাকথিত সচেতনতা কারোর ক্ষতির কারণ হওয়া উচিত নয়!
এই দুঃসময়ে উচিত-অনুচিতে ভুল না করে যারা অন্যের জন্য যুদ্ধ করছেন তাদের মনোবল বাড়াতে না পারলেও মনোবল গুড়িয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার মত দুঃসাহস না করাই ভালো। কারণ স্বাতীদের মারা বুকে পাথর রেখে, মনের ভয়কে পরোয়া না করে ছেলে মেয়েকে পাঠাচ্ছেন যুদ্ধে। তাই সৈনিকের সম্মানটুকু ওদের প্রাপ্য!
Comments are closed.