Also read in

Is Bengali a language 'only' of the poor?

৩০ কোটি বাঙালির বাংলা, আজ শুধু গরিবের ভাষা

যত বলি ‘নাই রাতি– মলিন হয়েছে বাতি’ মুখপানে চেয়ে বলে, ‘না, না, না।’ ও যে মানে না মানা।

কে চেয়ে আছে মুখ পানে, কে মানে না মানা? বাংলা ভাষা ! হে আ’মরি বাংলা ভাষা।… আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, প্রথমেই প্রণাম জানাই সব শহিদকে, জানি না যেখানে উনারা আছেন সেখানে ওদের কাছে কথাগুলো পৌঁছাবে কিনা, তবে শ্রদ্ধার সহিত আগেই সেই মাতৃভাষার জন্য নিবেদিত প্রাণ সব শহিদদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ এই লেখাটি অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও উনাদের অসম্মান করতে পারে। জানি না ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ ইং ) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে যখন রফিক, বরকত, আব্দুল জব্বারদের উপর গুলিবর্ষণ হয়েছিল তখন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা কি ছিল বা আজও ওপার বাংলায় কি অবস্থায় আছে আমার মাতৃভাষা। তবে আমার জন্মস্থান শিলচর ও ভারতে এ ভাষা এক আবেগের থালি যা দিয়ে পেট ভরার কোনো উপায় নেই।

আমি পেশায় সাংবাদিক তাই শুরু করি সাংবাদিকতা দিয়েই। বিগত ২ বছরে ভারতে প্রকাশিত হওয়া বাংলা দৈনিকগুলোতে চলছে ছাটাই অভিযান। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রকাশন ও, এই তো আনন্দবাজার বন্ধ করেদিল শিলচর এডিশন, এমনকি ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গায় এইসকল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বিশাল পত্রিকা যাকে বাংলা সাংবাদিকতার মেরুদন্ড বলা হয়, বিভিন্ন বিভাগ থেকে এক এক করে ৭০০ কর্মীকে চলে যেতে বললো। কর্তৃপক্ষ দায়ী করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডিমনেটাইজেশনকে। হ্যাঁ, তা সত্যি যে নোট বন্দির কারণে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে দিয়েছিলেন যার জন্য দেশ জুড়ে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলির আয় কমে যায়। কিন্তু হিন্দি দৈনিক ‘জাগরণ’ বা তেলুগু পত্রিকা ‘ইনাডু’ বা ‘মালায়ালম মনোরমা’ কি একইভাবে ছাটাই করেছে? উত্তর – না। তাহলে বাংলা ছাটাই কেন, এই প্রশ্নটা আমি আনন্দবাজার গ্রূপের এক উচ্চপদস্থ কর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি বললেন, “নোট বন্দি এক বাহানা। এডভার্টাইজাররা ক্রমশ বাংলা দৈনিকে এড দেওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, কারণ যাদের কাছে খরচ করার ক্ষমতা আছে ওরা আজ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা অন্য কোনো ইংরেজি দৈনিক পড়ছেন, নাহলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে খবর সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। এই ছাটাই এর আসল কারণ হচ্ছে, বাঙালি ইংলিশ টাকে এস্পিরেশনেল মনে করে এবং হিন্দিটা হচ্ছে স্টাইল স্টেটমেন্ট।”

উনার উক্তিতে যুক্তি থাকলেও আমার মনটা ঠিক মানতে পারলো না, আমি আইটিসির বিজ্ঞাপন বিভাগে কর্মরত আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেশ করলাম তোরা কি বাংলা দৈনিকে এড দিস্ না? ওর উত্তর আমায় হতচকিত করে দিল। ও বললো, “ম্যারি বিস্কুটের অ্যাড আমরা বাংলা পত্রিকায় দেই কিন্তু ডার্ক ফেন্টাসি অ্যাডগুলি ইংরেজি দৈনিক বা টিভি চ্যানেলগুলিতে প্রকাশিত হয়।” তার কারণ হচ্ছে আইটিসি ডার্ক ফ্যান্টাসি বিস্কুটটাকে একটি আপ মার্কেট মানে উচ্চবর্গের ক্রেতার প্রযোজ্য বিসকুট বলে “মার্কেট” করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা পত্রিকা ম্যারি বিস্কুটের যোগ্য আর ডার্ক ফ্যান্টাসি যাবে ইংরেজিতে তা কি ভাষার বিপন্নতা নয়?

আমার এক বাঙালি প্রফেসরের ভাই ১৮-২০ বছর থেকে লিখে যাচ্ছেন বিভিন্ন বাংলা দৈনিকে, যেমন কলমের ধার তেমনই খবরের কান – মাইনে ৬ বছর অভিজ্ঞ ইংরেজি সাংবাদিক থেকে কম। শুধু সাংবাদিকতায় যে এ অবস্থা তা মোটেও নয়, সংগীতের জগতে বিখ্যাত নাম অনুপম রায় “তুমি যাকে ভালোবাসো” লিখে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। এই মাসের শুরুতে আমাদের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান শিলচরে অনুষ্ঠিত হয়, এক সময় আমাদের একটি কনসার্ট করার ইচ্ছে হলে বিভিন্ন আর্টিস্টের চার্জেস জোগাড় করলাম। প্রথম নাম যেটা মাথায় এলো সেই “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও” মানে অনুপম রায়। এক সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের জন্য উনার ব্যাণ্ডকে দিতে হবে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। এক যুবা বন্ধু বললো অনুপম দা ‘গ্রেট’ তবে ইউটুবার ভুবন বাম ট্রেন্ডিং আস্লে হল ভরে যাবে, টিকিটও বিক্রি হবে। খবর নিলাম, ১২০ মিনিট পারফর্ম করবেন ১২ লক্ষ টাকা ফী দিতে হবে, তারপর বিজনেস ক্লাস এয়ার টিকিট পাচঁ তারা হোটেলে রুম। ভুবন বাম, যিনি বিবিকি ভাইন্স নামে পরিচিত ইউটুবে নিজের গান ও কমেডি পেশ করেন। সোনু নিগম এক সন্ধ্যার জন্য চার্জ করেন ১৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা।

এই বৈষম্যতা কেন? কারণ – বাঙালি বাংলা দেখা বা শোনার জন্য টাকা দিতে রাজি নয়। কিন্তু সেই বাংলায় বাংলার অনুপম রায়ের বদলে বাঙালিকে মিকা সিংহ বা ভুবন বাম কিংবা হানি সিংহ পেশ করলে ‘বেশ’ বলে টিকিট কাটতে রাজি। তা সিনেমা ইন্ডাসট্রিয়াল রিপোর্টটা দেখলে বোঝা যায়। হিন্দি হচ্ছে বলিউড, ইংরেজি হলিউড আর বাকি ভারতীয় ভাষায় বানানো সিনেমা ভার্নাকুলার বা রিজিওনাল সিনেমা। ভারতে ১০ কোটি বাঙালি আছেন। সমগ্র পৃথিবী গুনলে এ সংখ্যা ৩০ কোটি, পৃথিবীতে তামিলিয়ানের সংখ্যা ৮ কোটি, ভারতে ৭.২ কোটি, সারা বিশ্বে তেলুগু মানুষ রয়েছেন ৭ কোটি। এইবার দেখুন বক্স অফিস কালেকশন – ৩০ কোটি বাঙালির মাতৃভাষায় বানানো বক্স অফিসে সবচেয়ে বড় সিনেমা হচ্ছে ‘এমাজন অভিযান’ সারা বিশ্বে আয় ৪৮.৬৩ কোটি টাকা কামিয়েছে। বাঙালির সংখ্যাটা ৩০ কোটি মনে রাখবেন কিন্তু। সবচেয়ে বড় তামিল ছবি ‘এন্থিরান’ সারা বিশ্বে আয় ২২১ কোটি টাকা কামিয়েছে। তেলুগু ছবি ‘বাহুবলি ২’ সারা বিশ্বে আয় ১৮১০ কোটি টাকা, শুধু ভারতেই ৬৫০ কোটি। তবে কি বাঙালি সিনেমা বানাতে জানেনা? সত্যজিৎ রায়ের আবিষ্কৃত চরিত্র ‘পিকু’ আজ হিন্দি সিনেমার নাম, পরিচালনায় বাঙালি সুজিত সরকার, সংগীত নির্দেশক অনুপম রায়। সাধারণ বাজেটে অসাধারণ ছবি, আয় প্রায় ২০০ কোটির কাছাকাছি । তাই বাঙালি সিনেমা বানাতে পারেনা তা বলা যাবেনা। অথচ ৮ কোটি আর ৭ কোটি দর্শক ৩০ কোটিকে অনেক পিছে ফেলে দিচ্ছেন। কোথায় ৫০ কোটি আর কোথায় ২২১ কোটি আর ১৮০০ কোটি।

এক বছর হলো আমরা শিলচর থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খবর ছাপার আগে আমরা অনেক উচ্চপদে নিযুক্ত লোককে ফোন করি। বরাকের বাঙালি মানুষকে সিলেটিতে ‘বরাক বুলেটিন তিকিয়া কৈরাম’ বললে অনেক কম সময়ই উনাদের কাছ থেকে সম্মান সহিত উত্তর পেয়ে থাকি, তবে আই এম কলিং ইউ ফ্রম বরাক বুলেটিন বললে সম্মান ও উত্তর দুটোই পাওয়া যায়। এবার আপনারাই বলুন, বাংলা ভাষায় কথা বলে সম্মান না পেলে কত দিন আর এই ভাষায় লোক কথা বলবে? ভেবে বলুন, বাংলা ভাষায় গান বানালে কেউ টাকা দিয়ে অ্যালবাম না কিনলে কত দিন, কত জন বাংলা ভাষায় গান লিখবেন বা বানাবেন বা গাইবেন? ব্র্যান্ডেড গিটারের দাম মুম্বাই এ যত শিলচরে বা কলকাতায়ও তত। সেই গিটার আবার মুম্বাইয়ে হিন্দিতে বাজালে হাউসফুল আর কলকাতায় টিকিট থাকলে খালি চেয়ার।

উনিশ বা একুশে আল্পনা দিয়ে রাস্তা আঁকলে বা শহিদদের মালা পড়ালে তাতে বাংলা ভাষার কোনো লাভ হয় না। বাংলা ভাষার অবস্থা আজ জোনাকির মতো, বিদ্যুৎহীন আঁধারে জ্বলছে আর নিবছে তাই চোখে পড়ছে, আলোকিত পরিবেশে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই। আর তার জন্য দায়ী আমরা নিজেরা। আমরাই বাধ্য করে দিচ্ছি আনন্দবাজারকে তার কর্মী ছাটাই করতে, আজ আমাদের জন্য বাংলা পত্রিকা ম্যারি বিস্কুটের যোগ্য, আর ইংরেজি ডার্ক ফেন্টাসি। আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষার প্রতি সচেতন না হই তাহলে রাস্তার মোড়ে ফুচকাওয়ালা কাল বলবে ১০ টাকার খেলে বাংলা পত্রিকার প্লেটে আর ২০ টাকার খেলে টাইমস অফ ইন্ডিয়া।

Comments are closed.