Also read in

Journalism during a pandemic: Pranabananda Das writes about the current scenario

“আগামী আট দিন, এই অঞ্চলের সংবাদ মাধ্যমের জন্য এক নতুন পরীক্ষা”: প্রণবানন্দ দাস

সংবাদ মাধ্যমে আড়াই দশকেরও বেশি সময় হল কাজ করছি। কিন্তু এমন বেনজির পরিস্থিতির খবর যে কভার করতে হবে, তা কোনোদিন ভাবতে পারিনি। আজ থেকে মাস তিনেক আগে চিনের হুবেই প্রদেশের উহানে যখন প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর রটলো, তখন ভেবেছিলাম, এটা আর পাঁচটা ফ্লু হতে পারে। কিন্তু যেহেতু নিউজ ডেস্কে আমার উপর জাতীয়-আন্তর্জাতিক খবর সামলানোর দায়িত্ব থাকে, তাই এই খবরের উপর আমার তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ফলে, বড় কিছু যে ঘটতে চলেছে, তার আঁচ ঠিকই করতে পেরেছিলাম।

যেদিন উহানের রাস্তায় করোনা আক্রান্ত মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকার ছবি সংবাদ সংস্থা এএফপির আলোকচিত্রী দুনিয়ার সামনে এনেছিলেন, সেদিন সত্যিই আঁতকে উঠেছিলাম। কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি এই গ্ৰহ যে করোনার গ্ৰাসে চলে আসবে, তা কল্পনারও বাইরেই ছিল।

সেই করোনার তাণ্ডব এখন আমরা নিজেদের ঘরেই দেখছি। সত্যিকার অর্থে এখন মনে হচ্ছে, আমরা গ্লোবাল ভিলেজ- এ বাস করছি, যখন পড়শির ঘর ছারখার করে আগুনের লেলিহান শিখা আমাদেরও শেষ করে দিতে চাইছে।

সাংবাদিকতাকে আজকাল কেউ খুব বেশি সিরিয়াসলি নিতে চান না। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই সাংবাদিক। ফলে সাংবাদিকতা আজকের দিনে ‘থ্যাংকলেস জব’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যার মতো করে সাংবাদিকদের তকমা দিয়ে থাকেন। পেইড জার্নালিস্ট থেকে প্রেস্টিটিউট। নিত্য এসব গালাগাল খেয়েই সাংবাদিকদের কাজে যেতে হয়। অথচ দাঙ্গা বলুন বা বন্যা, নেতাদের বিশাল জনসভা হোক বা আজকের দিনের মহামারি—- মাঠে নেমে হাজারো সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় কিন্তু এই সাংবাদিকদেরই। চিনে এতবড় মহামারির খবর কিন্তু দুনিয়ার সামনে প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন উহানের এক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক-ই। কমিউনিস্ট শাসনে যেখানে খবর প্রকাশ বা প্রচারে রয়েছে বিস্তর কড়াকড়ি। ওই খবর যদি সেসময় প্রকাশ্যে না আসতো তবে আজ হয়তো লড়াই করারই সুযোগ পেত না দুনিয়া। অথচ আজকের দিনে ক’জন-ই মনে রেখেছে সেই চিনা সাংবাদিকের কথা!

এই লেখাটা যখন লেখছি, তখন মাথায় ঘুরছে আজ সন্ধ্যা থেকে শুরু হতে যাওয়ার লকডাউন। কীকরে আমরা দফতরে যাব, কীভাবেই বা খবর আসবে আর কাল আদৌ পত্রিকা প্রকাশ হবে কী না,— এসব অসংখ্য চিন্তায় লেখার খেই হারিয়ে ফেলছি। অশান্তির সময়ে কার্ফু চলাকালীন কাগজের দায়িত্ব সামলেছি। বন্যার সময় জলে মাখামাখি হয়েও কাজ করেছি। তাই বলে টানা আটদিনের জন্য লকডাউন! এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মোকাবিলা আমাদের আগে কখনো করতে হয়নি। সরকার ঘোষণা করে দায়িত্ব সম্পাদন করেছে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট শহর বা মফস্বল এলাকার সাংবাদিকরা কী করে খবর সংগ্রহ করবেন, তাদের নিরাপত্তা কে দেবে, বিকেলে তারা দফতরেই বা কী করে যাবেন…. তার খোঁজ তো কেউ রাখে না। একদিকে নেই আর্থিক নিরাপত্তা, অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তাও আজকের দিনে তলানিতে। দেশের বড় বড় শহরে সংবাদ মাধ্যম যে শক্তি, ভরসা ও সম্পদ নিয়ে এমন পরিস্থিতিতে কাজ করে, তার ছিটেফোটাও মেলেনা আমাদের মতো অঞ্চলে। অথচ খবর চাই “জাতীয় কাগজের” মতো! এ এক অদ্ভূত বিড়ম্বনা।

এই ক’দিনে নিউজ ডেস্কে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে ভুয়া খবর নিয়ে। প্রতিনিয়ত ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে ছড়াচ্ছে এমন খবর। করিমগঞ্জে করোনা আক্রান্ত ধরা পড়েছেন, শিলচর মেডিক্যাল কলেজ থেকে আক্রান্ত পালিয়েছেন, উধারবন্দের কাঁচাকান্তি মন্দিরে আগুন লেগেছে……. এমন অসংখ্য গুজব আছড়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এসব খবরের সত্যতা নিশ্চিত করতে ফোন আসছে মুহুর্মুহু। ধৈর্য ধরে প্রতিটির জবাব দিতে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব খবরের সত্যতা যাচাই করে নিতে হচ্ছে। পরেরদিন পাঠককে নির্ভুল খবর দেওয়াটাই এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও শিলচরের মতো প্রান্তীয় শহরগুলোতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন আমাদের সতীর্থরা। তাদের পিঠ চাপড়ানো দূরে থাক, নিদেনপক্ষে “ধন্যবাদ” বলারও কেউ নেই। অবশ্য সাংবাদিকরা এই “ধন্যবাদ” পাওয়ার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন না। পরের দিনের কাগজে তাদের খবর ঠিকঠাক ছাপা হলে, বা টিভির পর্দায় খবরটি ভেসে উঠলেই আসল তৃপ্তি, সব স্বীকৃতি।

আগামী আট দিন, এই অঞ্চলের সংবাদ মাধ্যমের জন্য এক নতুন পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় এর আগে আমাদের কখনো বসতে হয়নি!

এই প্রবন্ধের লেখক একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক

Comments are closed.