Also read in

"Kalika left a void, it is not easy to fill in his boots" Subha Prasad Nandi Majumdar

পৃথিবীর সমস্ত কাঁটাতার উঠে যাক, এটাই আমার স্বপ্ন: শুভপ্রসাদ

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভূমিকার প্রয়োজন গৌণ হয়ে যায়, যখন তার নামই ভূমিকার দায়িত্ব পালন করে। সেরকমই একজন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। বরাক উপত্যকার সংগীত জগতেতো বটেই বৃহত্তর বাংলায়ও এক সুপরিচিত নাম। সংগীত ও শিলচর অন্তপ্রাণ, অমায়িক হাসির অধিকারী শুভপ্রসাদ এর সঙ্গে আলাপচারিতায় একদিকে যেমন সংগীত নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল, তেমনি জানতে পারলাম তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনৈতিক স্বপ্নের কথা , জানতে পারলাম শিলচরের প্রতি তাঁর অপরিসীম টানের কথা। একইভাবে আলাপচারিতায় স্থান পেল এনআরসির বিভিন্ন দিক, শুনতে পেলাম কালিকার না জানা কিছুকথা। সবমিলিয়ে কথায় কথায় সময় গড়িয়ে গেল অনেকটা।এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির প্রথম অংশ আজ প্রকাশিত হলো। শেষাংশ আগামীকাল প্রকাশ করা হবে।

আমরা জানতাম, সঙ্গীত মানে সাধনা। একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তোমার কি মনে হয়, ইউ টিউবের দৌরাত্মে কিংবা সাফল্য লাভের সর্টকাট রাস্তা খুঁজতে গিয়ে সঙ্গীত সাধনা মুখ থুবড়ে পড়ছে?

আগেকার সময়ে গান আর শ্রোতার সম্পর্কটা এরকম ছিল যে গায়ক হলো পূজারী, গানটা হলো দেবতা আর শ্রোতা হল মন্দিরের ভক্ত। নাট মন্দিরের মধ্যে ভক্তরা বসতো আর পূজারী প্রতিমার দিকে মুখ করে পুজো করত। পেছনে নাট মন্দিরে ভক্তরা কি করছে সেদিকে তার নজর থাকত না। তার সমস্ত মনসংযোগ পুজোর মধ্যে এবং প্রতিমার প্রতি। এখানে শুধু পূজারী আর প্রতিমার মধ্যে সম্পর্ক। আর এখন পূজারী মূর্তিকে পেছনে রেখে নাট মন্দিরের দিকে মুখ করে পুজো করে।কাজেই প্রতিনিয়ত সে দেখছে ভক্তরা তাকে দেখছে কিনা, ওকে বুঝতে পারছে কিনা। ফলে পেছনে যে প্রতিমা, সে গৌণ হয়ে গেছে। এখন নাটমন্দিরে বসা দর্শকরাই প্রধান হয়ে গেছে।
সেভাবেই আগেকার দিনে গান আর গায়ক এর মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটাই উপভোগ করত শ্রোতারা নাট মন্দিরে বসে। গায়কও শ্রোতার কথা ভাবতো না। তার শুধু সম্পর্ক ছিল গানের সঙ্গে। গান আর গায়ক, ছিল দ্বিবিধ সম্পর্ক। শ্রোতা পেছনে।
আর এখন গায়ক শুধু শ্রোতাকে নিয়ে ভাবে, সে শ্রোতামুখী। ফলে গান গৌণ হয়ে গেছে। আগে গায়ক গায়িকারা বাজারের কথা ভেবে গান বাছতেন না। তাতে সাফল্য আসুক বা না আসুক। আর এখন মূল বিষয় হচ্ছে দর্শকের পছন্দ। বলা যায় বড় হয়ে গেছে দর্শক। মানে ঈশ্বরের চেয়ে বেশি ভক্তের দিকে নজর এখন পূজারীর।

আর ইউটিউবের ব্যাপারে বলতে পারি, আমাদেরকে টেকনোলজি সাহায্যও করতে পারে। এই যেমন বরাক উপত্যকায় বসে ইউটিউবে যে কেউ গান আপলোড করতে পারেন।তার জন্য কলকাতায় আসার প্রয়োজন নেই।এখন অনেকেই গান ফেসবুকের মাধ্যমে শেয়ার করেন। এক্ষেত্রে যাদের গান ভালো হচ্ছে তারা কলকাতায় ডাকও পান। টেকনোলজি কেন্দ্র ও প্রান্তের যে একটা দূরত্ব, তার ফলে যে অনেক প্রতিভাধারীরা স্বীকৃতি পান না, সেই দূরত্বটা গুছিয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা টেকনোলজিকে কাজে লাগাতে পারি।

তাহলে প্রযুক্তি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করছে এগিয়ে যাওয়ার পথে? কিভাবে বিশ্লেষণ করবে?

মনে কর একটি ছুরি। আমি সেটাকে কিভাবে ব্যবহার করবো,সেটা নির্ভর করবে আমার উপর। এটি ভালো কাজেও ব্যবহৃত হয়, আবার উল্টোটাও হয়।

আগেকার সময়ে টেকনোলজি বা সাউন্ড সিস্টেম তেমনকরে ছিল না বলে গায়ককে অনেক চড়া গলায় গান গাইতে হত। এখন সাউন্ড সিস্টেম আসায় এ নিয়ে আমরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি। গলার মডুলেশনগুলো কাজে লাগানো সম্ভব, নানা ধরনের ধ্বনি ব্যবহার করতে পারি, অনেক ধরনের যন্ত্রের বহু ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে। টেকনোলজি আমাদের এ সুযোগও দিচ্ছে, কণ্ঠের যে বিভিন্ন মাত্রা আছে সে গুলোকেও ধরার। তাই আমি টেকনোলজিকে কিভাবে ব্যবহার করব সেটার উপর সব কিছু নির্ভর করছে। আমি কণ্ঠস্বরের যে বৈচিত্র তাকে ধরার জন্য, না কণ্ঠের যে দুর্বলতা সেটাকে ঢাকার জন্য টেকনোলজি ব্যবহার করব? তবু
এই টেকনোলজির মাধ্যমেই এখন সবাই শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন। আবার অন্য দিকে বাছ বিচার ছাড়াই সবাই পৌঁছে যাচ্ছে শ্রোতার কাছে। দুটো দিকই রয়েছে।তাই টেকনোলজি আশীর্বাদও হতে পারে আবার অভিশাপও।

কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের এত বেশি বিহ্বল করে দিয়েছে যে, প্রযুক্তিটা কতটুকু ব্যবহার করা উচিত সে মাত্রা জ্ঞান এখন অনেক ক্ষেত্রেই নেই। ১৯৯০-৯১ সালের পর থেকে পৃথিবীটা বদলে গেছে। সব কিছু পণ্যমূল্যে নির্ধারিত হয়। তাতে কি হয়েছে, মনে কর গায়ক, তার গান তার কথা,এমন কি আমার হাসি, আর একজনের কান্না সমস্ত কিছু শেষ পর্যন্ত এক পণ্যমূল্যে নির্ধারিত হতে লাগল। আগে কি কখনো আমরা ভেবেছি, যে নিউজ এরও একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হতে পারে? এখন সেটা হচ্ছে। সংবাদ শুনছি, কোনও একটা জায়গায় একটা খুন হয়েছে, পেছনে একটা ঢং করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। তাই কোনটা সিনেমা আর কোনটা নিউজ তা বোঝা যায় না। সব একাকার হয়ে যাচ্ছে।আমরা এখন সবাই এক একটা পারফর্মার হয়ে যাচ্ছি। আর মানুষ হয়ে যাচ্ছে এক এক জন কাস্টমার। এই যে সময়টা এভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, এতে করে আমাদের শিল্পের ক্ষেত্রে গানের ক্ষেত্রে সাহিত্যের ক্ষেত্রে, কবিতা,গল্প,সিনেমা বল বা নাটক বল, সব জায়গায় রুচির একটা অবনমন ঘটছে।

বরাক উপত্যকার দু চারজন বৃহত্তর বাংলায় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নিজের স্থান করে নিতে পারলেও সংখ্যাটা সীমিত কেন?

এখানে আমাদের একটা সমস্যা যে গান বাজনার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজধানীতে পৌঁছাতেই হবে। যে পৌঁছাতে পারল তার তো ঠিক আছে, কিন্তু যে পৌঁছতে পারল না সে কি তার যোগ্যতার জন্যই পৌঁছতে পারল না? এখানে যোগাযোগ, চান্স ফ্যাক্টর অনেক কিছু কাজ করে। তবে বর্তমানে টেকনোলজির সুবাদে কেউ বরাক উপত্যকায় বসেও ইউটিউব এর মাধ্যমে বা অন্য কোনও মাধ্যমে গান আপলোড করতে পারেন। তার জন্য আর কলকাতায় আসার প্রয়োজন নেই। যারা ভালো গাইছেন তারা গানের জন্য ডাকও পাচ্ছেন। সঙ্গীতে সফল হওয়ার জন্য রাজধানীতে পাড়ি দেওয়া জরুরি নয়।

আরও একটা ব্যাপার আমি উল্লেখ করতে চাই, বরাক উপত্যকার একটি পজিটিভ দিক রয়েছে। আধুনিক সমাজের পণ্যায়িত সময় আমাদের ততটা গ্রাস করেনি। খুব সুন্দর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে,একটা দেবজিত যখন সা রে গা মা তে গান গাইছে তখন গোটা বরাক উপত্যকা ভাবছে ‘আমি’ গান করছি, মানে সে নিজে গান করছে। একটা কালিকাপ্রসাদ যখন সা রে গা মা তে বিচারকের ভূমিকা পালন করে, তখন বরাকের সবাই ভাবে সেটা আমি। এটি আসলে আদিম কৌম্য সমাজের লক্ষণ।প্রত্যেকটা ‘আমি’ আসলে ‘আমরা’।

তাহলে তোমার কাছে সঙ্গীত জগতে একজনের সফল হওয়ার সংজ্ঞা কি ?

এটি নির্ভর করে নিজের সংগীত আদর্শ বা জীবনাদর্শ কি? যে গান করছে, সে বাণিজ্যিক মূল্যে নিজের সাফল্যের হিসাব করবে? না গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তার আত্ন তৃপ্তির মূল্যে সে নিজেকে বিচার করবে? না রসজ্ঞ শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর মূল্যে বিচার করবে?

এক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার শিল্পীদের অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলবে?

বরাক উপত্যকায় এমন অসংখ্য শিল্পী আছেন যারা কৃতি এবং সঙ্গীত জগতে সফল। যেমন মৈত্রেয়ী দাম, শিবানী ব্রহ্মচারী তারা একটি ধারা তৈরি করেছেন। তাছাড়া বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী, তাপশ শংকরদেব,যারা আমাদের অহংকারের অঙ্গ। যাদের গান নিয়ে বরাক উপত্যকার মানুষ গর্ব বোধ করে। একটা অঞ্চলের সম্মিলিত অহংকারের প্রতীক। এটাই আমার মতে সাফল্যের মাপকাঠি। আমাদের সুদীপ্তা, নতুন মেয়েদের মধ্যে এত ভালো গান গাইছে। ফেসবুকের মাধ্যমে গানগুলো শেয়ার হলে সবাই শুনছে, কলকাতার মানুষ ওর গান শুনে অবাক হয়ে যায়। এগুলোও গানের সাধনায় সিদ্ধিলাভের অঙ্গ।
বিশ্বজিৎ,পঙ্কজ, মৈত্রেয়ীদি, তাপশ শংকর দেব,শাশ্বতী,বিধান লস্কর, নীলিমা দেব, সুব্রত খাজাঞ্চি, আরও আরও অনেকেই রয়েছেন। এই নামগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে এক অহংকার আসে, গর্ববোধ হয়। এটাই তাদের সাফল্য। এদের বাইরেও আরও অনেকে রয়েছেন যারা খুবই ভালোভাবে সঙ্গীত সাধনা করছেন। আবার অনেকেরই হয়তো অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রচেষ্টা প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেটা সত্যি দুর্ভাগ্যের!

নমামি বরাক নিয়ে একটু জানতে চাইবো। নমামি বরাকের থিম সং এর অসম্পাদিত ভিডিওটি আমাদের ‘মাই শিলচর” পেইজে প্রথম বেরিয়েছিল, যেখান থেকে সেটা ভাইরাল হয়ে যায় । বরাকের জনগণ এর পরের ঘটনায় যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তাই তোমাকে বাদ দেওয়ার কারণটা তোমার মুখেই শুনতে চাই

‘নমামি বরাক’ এর গানের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমারই ছাত্র বাপন……জানতে চায় কে ভালো লিখতে পারে,কে ভালো গাইতে পারবে? সে সময় আমি ওকে বরাক উপত্যকার কয়েকজনের নামও বলেছিলাম।গান লেখা হল।সব কথাবার্তা হল। তারপর আর যোগাযোগ নেই। হঠাৎ একদিন ফোন করে বলল, কালই রেকর্ডিং। রেকর্ডিং এর জন্য পরের দিন কলকাতায় আসতে। তারপর রেকর্ডিংও হলো…… এরপর আর আমার কিছু জানা ছিল না।
একদিন হঠাৎ শিলচর থেকে ফোন পেয়ে জানলাম যে আমাকে ওই গানের ভিডিও থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ,কারণ আমার রাজনৈতিক অবস্থানের কথা ভেবে, সামাজিক মাধ্যমে আমার রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য। তখন আমি শুধু বললাম, আমার রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা বক্তব্য সেটা তো প্রথম থেকেই স্পষ্ট………. সেটা জেনেই তো গান গাওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। আরও আশ্চর্য, এমনকি বাদ দেওয়ার পরও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। ব্যক্তিগত ফোন, সামাজিক মাধ্যম,পত্রিকা থেকে আমি জানতে পেরেছি। এমনকি পরে আমাকে দেশদ্রোহী আখ্যাও দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আর কি বলতে পারি।
আমার শুধু এটাই বক্তব্য, এতো দলীয় কিছু ছিল না। এটা তো ছিল সরকারের অনুষ্ঠান। আর সরকার তো সবার। সরকার তো কোনও দলের নয়। যে ভোট দেয় তার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, আর যে ভোট দেয় না তারও প্রধানমন্ত্রী।যাক্,এটা যার যেমন বিবেচনা। এ ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, অসন্তোষ নেই, ওরা ডেকেছিল তাই কৃতজ্ঞ। বাদ দিয়েছে নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কিছুর কম রয়েছে।
কেউ আমাকে পছন্দ করতে পারে, আবার কেউ আমাকে অপছন্দও করতে পারে। কিন্তু পছন্দ, অপছন্দ দুটো ক্ষেত্রেই সততা থাকা উচিৎ। আমার একটাই দুঃখ,আমাকে প্রকাশ্যে দেশদ্রোহী বলেছে যে ,সে নিজেই পরে আমার মেয়েকে বলেছে, তোমার বাবাকে যে দেশদ্রোহী বলেছি সেটা রাজনীতি। আমরা ওকে খুবই ভালোবাসি। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট, আমাকে যে দেশদ্রোহী বলা হয়েছে, তার মধ্যেও ওদের সততা নেই।

এবারে কালিকাপ্রসাদ সম্পর্কে তোমার মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে চাই,যেটা হয়ত অনেকেই জানে না।তোমাদের সম্পর্কের বাঁধনটাতো সবার জানা।

সে আমার বয়সে অনেক ছোট ছিল। ওর পিসির কাছে গান শেখার সময় ওকে আমি কোলে নিয়েছি। তার যে অবদান, তার যে মেধা, তার যে প্রতিভা সেখানে সে আমার অনুজ নয়, অগ্রজ।

তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে আসলে দেখিয়ে গেছে আসলে সে কে? ওর মৃত্যুর পরে পরেই আমি বাংলাদেশ গিয়েছিলাম, ওর স্মরণে  একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।তখন দেখেছিলাম ঐ দেশে তাঁর জনপ্রিয়তা।

তাঁর গান বাজনার বিশাল একটা অংশ যেহেতু পূর্ববঙ্গ বা সিলেটের গান নিয়ে তাই বাংলাদেশের মানুষ ভাবে সে তাদের ছেলে।আবার পশ্চিমবাংলায় যেহেতু সে গান গেয়েছে বাংলার মানুষ হবে সে আমাদেরই ছেলে।একই ভাবে বরাক উপত্যকার বা আসামের বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে করে কালিকাতো আমাদেরই ঘরের ছেলে। কথাটা বললে হয়তো অনেক বড় হয়ে যাবে, এই যে রবীন্দ্রনাথ নজরুল লালন কোনও সীমান্তের কাঁটাতার মানেন না। সব কাঁটাতারকে তুচ্ছ করে সবাই এদের নিজের সন্তান বলে মনে করে।এই জিনিসটা দীর্ঘদিন পরে এক বাঙালির মধ্যে দেখতে পেলাম, সে হলো কালিকা। পশ্চিম বাংলা, উত্তর পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ কিংবা বিদেশে যেখানে যত বাঙালি আছে প্রত্যেকে তাঁকে নিজের সন্তান মনে করে।এটা একটা জীবনের বড় অর্জন। একটা মানুষের জন্য কাঁটাতার বৃথা হয়ে যাচ্ছে, তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে- সেটা তো নিসন্দেহে জীবনের একটা মস্ত বড় পাওনা!
সে যখন জীবিত ছিল তখন বাংলাদেশের আবৃত্তিকার, অভিনেতা ও বর্তমান সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন,
ভারতবর্ষকে যদি কোনও একটা কারণে হিংসে করতে হয়, সেটা হল আপনাদের একটা কালিকাপ্রসাদ আছে, আমাদের নেই। আবার সে মারা যাওয়ার পর তিনিই আবার বলেন, বাঙালি হিসেবে আমাদের একটা গর্ব যে আমাদের কালিকাপ্রসাদ ছিল।

আর একটা ব্যাপার, লোকগানে তাঁর অবদান আকাশ ছোঁয়া।অনেক বড় বড় শিল্পীরা গ্রামীন লোকশিল্পীদের গান গেয়েছেন,তখন শুধু ওদের গান কলকাতায় নিয়ে এসেছেন, তাদের কথা কোনদিন বলেন নি। কিন্তু কালিকা যাদের গান গেয়েছে, তাদের কথাও সবার সামনে নিয়ে এসেছে। সে আব্দুল করিম এর কথা বলেছে, কালাচাঁদ দরবেশ এর কথা বলেছে। যাদের কাছ থেকে সে গান তুলেছে, তাদেরকেও জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে। তাঁর দলের নাম যে “দোহার”, তারও বিশেষ এক অর্থ আছে। সে বোঝাতে চেয়েছে, আসলে গানটা ওরাই গায়, গ্রামীণ লোকশিল্পীরা, আমরা শহরে বসে দোহার দেই।এই যে একটা বোধের জায়গা, একটা দৃষ্টিভঙ্গি এটা একটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সে লোকসঙ্গীত গাইতে গিয়ে কখনও কিবোর্ড কিংবা কোনও আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্র ব্যবহার করেনি।সমস্ত লোকায়ত যন্ত্র ব্যবহার করেই লোকগীতি গেয়েছে।এখানে সে আপোস করেনি।
আর একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না, জি টিভি যখন তাকে ডাকে তখন সে জি টিভিতে বাণিজ্যিক সঙ্গীতের কেন্দ্র স্থলে লোকায়ত গান, লোকশিল্পী, মাটির শিল্পী, নাম না জানা শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে শান্তনু মৈত্র, লোপামূদ্রা, শোভা মুদগল তারা বসে সেই গ্রামের মনসুর ফকির কিংবা অন্যান্যদের গান শুনছেন সারা দিন ধরে।এটা অভাবনীয়! ওরা নিজেরাও বলেছেন, কালিকা না থাকলে এই শিল্পীদের কথা, এই শিল্পের কথা তেমনকরে জানতেই পারতাম না। এটা একটা বড় অবদান।
বাংলাদেশের “ভূবন মাঝি” সিনেমার জন্য তাঁর যে শেষ গানটা “আমি তোমারই নাম গাই” বাংলাদেশে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছে এবং সবার মুখে মুখে ফিরে এই গানটা। আমারতো মনে হয়, প্রসাদের যদি আর কিছু থাকত না, শুধু এই গানটা থাকত তাহলেও বাঙালি তাঁকে সারা জীবন মনে রাখত।
কালিকা মারা যাওয়ার পর ওর এই গানটা শুনতে শুনতে মনে হল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর সমাধি ফলকে কি লেখা হবে, একই ভাবে কালিকাও যেন শেষ কথাগুলো বলে গেল গানের মাধ্যমে!

কালিকার না জানা কথাগুলো তোমার মুখ থেকে শুনতে কিংবা জানতে খুবই ভালো লাগছে। তাই আমার মনে হয়, এ বিষয় নিয়ে আলাদা করে আরও একটা বৈঠক খুব জরুরি।

আসলেও কালিকার কথা শেষ হওয়ার নয়। ঠিক একইভাবে বলতে পারি, তাঁর শূণ্য স্থান পূরণ হওয়া এত সহজ না!

(সাক্ষাৎকারের শেষাংশ আগামীকাল প্রকাশিত হবে)

Comments are closed.