Also read in

Online Classes; Is it really feasible for the teachers of government schools

অনলাইন ক্লাস: সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু উপযোগী?

 

আইজ্যাক আসিমভ, প্রখ্যাত এক গল্প লেখক ১৯৫১ সালে একটা গল্প লিখেছিলেন-‘দ্য ফান দে হেড’। গল্পের ঘটনাগুলো ঘটছে ২১৫৭ সালে। জীবন্ত শিক্ষক, স্কুল আর কাগজে ছাপা বই- তখন প্রগৈতিহাসিক যুগের বিষয়। গল্পের মূল চরিত্র মার্জি স্কুলকে রীতিমত ঘেন্না করে। সে তো স্কুল দেখে নি। তার স্কুলরুম শোবার ঘরের পাশেই। সেখানে সে যন্ত্র শিক্ষকের কাছে পড়ে। হোমটাস্ক গুঁজে দেয় যন্ত্রের নির্দিষ্ট স্লটে। তাই তার টমি যখন একটা বই খুঁজে পায়, যার একটা ধরা ছোঁয়ার শরীর আছে , সে অবাক হয়।ডায়েরিতে লিখে রাখে ঘটনাটি। আমরা কি এরকম একটা সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি? যখন ডিজিটাল ভারত স্কুলের ক্লাসরুম থেকে অনলাইন ক্লাসরুমকেই বেশি গুরুত্ব দেবে? ই- বুক নামটির সঙ্গে এতদিন আমাদের এতটা পরিচয় ছিলনা। যদিও ই- বুকের বয়স আধ শতাব্দী হলেও এদেশে ই- বুকের যাত্রা এক দশকের বেশি নয়। বৈশ্বিক মহামারীর এই সময়ে ই- বুক নির্ভরতাটা বাড়ছে। ক্যাসেট যেমন মুছে দিয়েছে রেকর্ডকে, পেনড্রাইভ যেমন সিডিকে, তেমনি কি মুদ্রিত বইকে হারিয়ে দেবে ই- বুক?দেখা দিয়েছে এই আশঙ্কাটাও। অতিমারীর এই সময়ে অনলাইন ক্লাসের উপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে শিক্ষাব্যবস্থা। গ্রাম ভিত্তিক আমাদের এ দেশে, এই রাজ্যে যেখানে মিড ডে মিল খাওয়ার তাগিদে ছেলেমেয়েরা স্কুলে নাম লেখায়, সেখানে অনলাইন ক্লাস কতটুকু সফল হতে পারছে? স্মার্ট ডিভাইস, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিংবা নিদেনপক্ষে মোবাইল কি পারছেন সব অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতে? পারছেন না। অনলাইন ক্লাসে হাজারো সমস্যা। তারপরও অনলাইন ক্লাসে কতটুকু আগ্রহী ছেলেমেয়েরা- এ নিয়ে ইতিমধ্যে একটি সমীক্ষাও করেছে ব্রেনলি। যদিও একাংশের মতে, অনলাইনের চেয়ে ঢের ভালো ক্লাসরুমে চক ডাস্টার হাতে স্যার দিদিমনির পড়ানো। প্রায় ৩৭ শতাংশ ছাত্রছত্রী স্কুলে যেতে চাইলেও ৫৩.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কিন্তু দুই পদ্ধতিতেই রাজি। অন্যদিকে ৪২.৫ শতাংশ কেবল অনলাইনে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়।সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে যে, প্রায় ৫৫.২ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ক্লাসকে উপভোগ করছে।আগামীদিনে প্রায় এক তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী অনলাইনে পড়াশোনা করতে চায় বলে ব্রেনলির সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বৈশ্বিক এই সংকটে যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি হুমকির মুখে । ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষানীতিও। ক্ষতিটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই সময়ে শুধু আমাদের দেশ কেন, সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার ভরসা অনলাইন ক্লাস।

অনলাইন টিচিং-লার্নিং–শব্দগুলো যেন শুনতে নামীদামী ব্র‍্যান্ড নেম।বেশ একটা অভিজাত ভাব আছে শব্দবন্ধটিতে। করোনাকালে এই শব্দবন্ধটিই শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা। নিয়মিত পড়াশোনার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত রাখতে এখন অব্দি অনলাইন টিচিং’য়ের বিকল্প আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় নি। প্রাইভেট স্কুলের পড়ুয়া কিংবা টিচারদের তো আজকাল অনলাইন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। সরকারি স্কুলগুলোও কম যায় না। তারাও কোনরকমে কিছু ছাত্র জুটিয়ে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে ক্লাস চালাচ্ছেন। নোটস দিচ্ছেন। কেউ কেউ সিলেবাসের নিদৃষ্ট পাঠ বিশ্লেষনের অডিও কিংবা ভিডিও রেকর্ডিং করে গ্রুপে দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে টেস্ট নিচ্ছেন। বাইরে থেকে দেখতে গেলে মনে হবে অনেক কিছুই হচ্ছে।টিচাররা রেকর্ডেড ভিডিও ক্লাসে পারফরমেন্স দেখাচ্ছেন। স্টুডেন্টরা কতটুকু কি নিতে পারছে, সেটাতে সন্দেহ আছে। এবছরটা হয়ত শিক্ষার্থীদের এই অনলাইন টিচিংয়ের ভরসায়ই কাটাতে হবে।

আমরা যারা গ্রাউন্ড জিরোর সঙ্গে সংযুক্ত, আপন যাপনে শহুরে হলেও আমাদের জীবিকার ভরসা গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো। সে সঙ্গে শহরের পাশাপাশি গ্রামে একটা বাড়ি থাকার সুবাদে গ্রামীন জীবনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে। শুধু আমি নই , আমার মত অনেক আছেন, যারা গ্রাম- শহরের খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে, তাদের ছেলেমেয়েদের জীবনকে, যাপনকে কাছ থেকে দেখছেন। তারা জানেন , অনুভব করেন তাদের সমস্যাকে। এদেশের বড় বড় শহর- মেগাসিটির প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলিতে কিংবা বিদেশের স্কুলে অনলাইন টিচিং-লার্নিং প্রসেস ফলপ্রসূ হতে পারে, কারণ ওখানে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর মত প্রেক্ষাপট আছে। অনলাইন টিচিং প্রসেসটা তাই উন্নতমানের, স্টুডেন্টরা উচ্চবর্গীয় ধনী পরিবারের সন্তান। তাই তারা লাইভ ক্লাসরুম কিংবা গুগল ক্লাসরুমের সুবিধাগুলো নিতে পারছে । ওইসব স্কুলগুলোতে ক্লাস প্রতি ৩০- ৪০জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। স্কুলগুলো webex meet app জাতীয় নিজস্ব কিছু অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে সরাসরি এক একটি ক্লাসের সব শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হন শিক্ষকরা । যাকে বলে লাইভ ক্লাসরুম। স্টুডেন্টরা টিচারদের সরাসরি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় স্টুডেন্টদের পরীক্ষাও নেওয়া হচ্ছে। তাই ওসব প্রেক্ষাপটে অনলাইন ক্লাস কার্যকর হতে পারলেও আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ যে প্রেক্ষাপটে আছে, তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস অনেকটা অশ্বডিম্ব প্রসব করছে মাত্র। উদাহরণ হিসেবে আমাদের আসামের কথাই ধরা যাক। আমার রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি স্কুলগুলো যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, এসব স্কুলে যেসব ছেলেমেয়েরা পড়ছে, তারা যে প্রেক্ষাপট থেকে আসছে , তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস তেমন কার্যকর হচ্ছে না। আমার শহরের বাড়ির উল্টোদিকেই রয়েছে একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল। এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই যেসব পরিবার থেকে আসছে সেখানে তাদের অনেকের কাছে এনড্র‍য়েড মোবাইল স্বপ্ন মাত্র! শিক্ষার্থীদের অনেকের মা বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ, রান্নার কাজ করেন, কিংবা বস্তা- ব্যাগ সেলাই করেন, বাবারা হয় ঠেলা- রিক্সা চালান, নয়ত মিস্ত্রির কাজ করেন। তাদের কারো কারো পরিবারের দুজন কিংবা চারজন ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। খেটে খাওয়া,এসব পরিবারে তিনবেলা ডাল- ভাত জোগাড় করা যেখানে সমস্যা, সেখানে স্মার্ট ফোনে স্মার্টনেস দেখানোর মত ক্ষমতা তাদের নেই। যদিও বা কারো কারো পরিবারে এনড্র‍য়েড মোবাইল একটা থেকেও থাকে, নিয়মিত চার- পাঁচ শ টাকার নেটপ্যাক ভরা সম্ভবপর হয় না। তাই দেখা যাচ্ছে, একটা স্কুলে যদি ছয় – সাতশ স্টুডেন্টস থাকে , হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে থাকছে মাত্র দুই থেকে আড়াইশ স্টুডেন্টের নাম।অন্যান্য স্কুলগুলিতে তো এসংখ্যা আরো কম। গ্রামের স্কুলগুলোর অবস্থাতো আরো দুর্দশাগ্রস্ত। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষকের অভাব। প্রতিবছর অবসরে যাচ্ছেন শিক্ষক, ওইসব জায়গাও যেমন পূর্ণ হচ্ছে না, তেমনি অনেক বিষয়ের শিক্ষক পদই শূন্য বছরের পর বছর ধরে। এসব স্কুলে চল্লিশজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকার ভাবনা তো অলীক স্বপ্ন মাত্র। আমি যে সীমান্ত গ্রামের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করছি, সেটি ভারত – বাংলা সীমান্তপারের এক বিশাল অঞ্চলের একমাত্র হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক, না আছে প্র‍য়োজনীয় ক্লাসরুম , না পর্যাপ্ত ডেস্ক- বেঞ্চ। এক একটি ক্লাসে এক থেকে দেড়শ স্টুডেন্ট। একজন শিক্ষকের পক্ষে এতজন স্টুডেন্টকে সামাল দেওয়া কতটুকু সম্ভবপর, সহজেই অনুমেয়। তার উপর স্কুলে না আছে ক্লার্ক। শিক্ষক- শিক্ষিকাদের পড়ানোর পাশাপাশি ক্লার্কের কাজ, তার উপর জাতীয় কর্তব্যগুলো- যেমন ইলেকশন ডিউটি, এন আর সি ডিউটি, সেন্সাস ডিউটি করতে হয়। বছরের অর্ধেক সময় তো এসব জাতীয় কর্তব্যে টিচারদের নিয়োজিত থাকতে হয়। তার উপর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ঠিকমত পারফরমেন্স দেখাতে না পারলে আবার অধ্যক্ষকে জবাবদিহি করতে হয়। স্টুডেন্টরা যে প্রেক্ষাপট থেকে আসছে, তাদের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতেই অনেক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়।

অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে সচেতন নন। অনলাইন টিচিং তাদের জন্য বাগাড়ম্বর মাত্র। প্রত্যেক টিচারদের পড়ানোর একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। একজন শিক্ষিকা হিসেবে যতটুকু অনুভব করেছি, ক্লাসে পড়াতে গেলেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে পড়াটা বের করতে হয়। ক্লাস ইলেভেন- টুয়েলভের স্টুডেন্টদের পড়াতে গিয়েও দেখছি, অনেকে শুদ্ধভাবে বাংলা দুলাইন পড়তে পারে না। লাস্ট বেঞ্চ স্টুডেন্ট কিছু থাকে, যারা ফাঁকিবাজির উদ্দেশ্য নিয়েই ক্লাসে আসে। তাদেরকে মোটিভেট করতে হয়।পাঠ বোঝাতে গেলে লাইনে লাইনে প্রতিটি শব্দের অর্থ বলে দিতে হয়। নোটস দিতে গেলে প্রতিটি বানান বলে দিতে হয়। তারপরও অনেকসময় এরা খাতায় ভুল লিখছে। ক্লাসে ছাত্র- শিক্ষক সমন্বয়, কথোপকথন একান্ত জরুরি। ক্লাস টেস্ট নিতে গেলে, তাদের অনেকেই ফাঁকিবাজির কিংবা পাশের বা পিছনের সহপাঠীর খাতা কপি করার কিংবা লুকিয়ে বই খুলে লিখার সুযোগ খুঁজে। টিন এজের এই ছেলেমেয়েগুলো বয়সের দুষ্টুমিতে নিজেরা যে নিজেদের ঠকাচ্ছে, সেটাও অনুভব করে না। এসব স্টুডেন্টকে নানা ভাবে মোটিভেট করে পড়িয়ে রেজাল্ট আদায় করতে হয়। যদিও বর্ষশেষে তারা আমাদের হতাশ করে না, সত্তর থেকে আশি শতাংশের বেশি স্টুডেন্ট সফল হচ্ছে প্রতি বছর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায়। এতসব প্রসঙ্গ টানলাম যা বলতে, তাহল, এসব স্টুডেন্টরা একটু সাহচর্য আর উৎসাহ পেলে পড়াশানায় আগ্রহ দেখায় ঠিক, কিন্তু অনলাইন ক্লাসটা তাদের জন্য নতুন, তারা নিজেদের আগ্রহে যে উৎসাহিত হবে অনলাইন ক্লাসে, রেকর্ডেড ভিডিও কিংবা অডিও ক্লাস শুনে পাঠ বুঝে নেবে , সে প্রত্যাশাটা করা বোকামি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, ওইসব অঞ্চলে নেট তো দূর , ফোনের নেটওয়ার্কই থাকে না। আর এনড্র‍য়েড মোবাইল সে তো হাতে গোনা। তাই এই অনলাইন পাঠের সুযোগ তো কুড়ি শতাংশ ছাত্ররাও পাচ্ছে কি না সন্দেহ।আমার স্কুলের এই যে ছবি, এটা শুধু একা আমার স্কুলের ছবি নয়, অজস্র গ্রামের অজস্র স্কুলের একই ছবি। রাজ্যের খোদ শিক্ষামন্ত্রীও জানেন, আমাদের রাজ্যে, আমাদের শহরে, আমাদের গ্রামে অনলাইন শিক্ষাদান ততটুকু কার্যকর নয়। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন রাজ্যের শুধুমাত্র ২৭ শতাংশ স্টুডেন্টদের কাছে এনড্র‍য়েড মোবাইল আছে। এই সময়ে বাকি অংশের হাতে এনড্র‍য়েড মোবাইল তুলে দেওয়াটা সম্ভবপর নয়। তারপরও করোনাকালে অনলাইন টিচিংকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো স্টুডেন্টের সঙ্গে টিচারের যাতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।

এই করোনা কালে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরনটা যেন আরো রমরমিয়ে চলছে। সামাজিক দূরত্বের নিষেধাজ্ঞা মানতে গিয়ে স্কুল- কলেজ বন্ধের পাশাপাশি প্রাইভেট কোচিং ক্লাস বা গ্রুপে প্রাইভেট টুইশ্যন বন্ধ। পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই প্রাইভেট টিউশন বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রাইভেট টিউশন বন্ধের সুযোগকে কাজে লাগাতে শুরু হয়েছে অনলাইন টিচিং- লার্নিং অ্যাপ। যেগুলোতে বেশ বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নাম রেজিস্ট্রেশন করাচ্ছেন। যদিও এই সুযোগটা শুধু নিচ্ছেন ধনী অভিভাবকরাই, যাদের ছেলেমেয়েরা নামকরা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করছে। সব মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা এসময়ে যেন পুরোপুরি মোবাইল ভিত্তিক হয়ে গেছে। এই মোবাইল নির্ভরতাকে কিন্তু কাঁচা বয়সের ছেলেমেয়েরা অন্যভাবেও কাজে লাগাচ্ছে। তাঁরা পড়াশোনার অজুহাতে দিনরাত মোবাইল হাতে নিয়ে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকছে। আজকালকার বাচ্চারা অনেক তুখোড় ও বুদ্ধিমান। তারা অভিভাবককে ফাঁকি দিয়ে পড়াশোনার চাইতে মোবাইলকে নানা গেমে বেশি ব্যবহার করছে। এমনিতেই আজকালকার প্রায় সব ছেলেমেয়েরা মোবাইল গেম ইত্যাদিতে আসক্ত।

করোনাকালে এই মোবাইলভিত্তিক পড়াশোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছেলেমেয়েগুলো যেন হয়ে পড়েছে পুরোপুরি মোবাইলবন্দি। অদূর ভবিষ্যতেই হয়ত এই মোবাইল নেশা ড্রাগের নেশার হারকেও ছাড়িয়ে যাবে, হতে পারে সভ্যজগতের মানুষের জন্য এক হুমকির কারণ।

মোবাইলই যে এ সময়ে শুধু অনলাইন ক্লাসের একমাত্র মাধ্যম তা নয়। রেডিও বা দূরদর্শনে শিক্ষামূলক ক্লাসকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে,এনড্র‍য়েড মোবাইলের সুবিধা থেকে সরকারি স্কুলের যে ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত, তারা রেডিও বা দূরদর্শনের ক্লাস থেকে উপকৃত হচ্ছে। এর সুযোগ নিতে পারছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদপেই কি সেটা হচ্ছে? রেডিও বা দূরদর্শনের ক্লাসের জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। সরকার যদি রেডিও বা দূরদর্শনের কাছ থেকে টাইম স্লট না নেয়, তাহলে শিক্ষকদের কিংবা স্কুলগুলোর উদ্যোগে একাজ সম্ভব নয়। রাজ্যের এবং দেশের কোন কোন জায়গায় শুনেছি দূরদর্শনে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। কিন্তু এই বরাক বাংলা এবং দেশের বেশির ভাগ জায়গায় গ্রামীন শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে রেডিও ক্লাসকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আজকাল শহর তো দূর, গ্রামে ঘুরে আসুন, বাড়ি বাড়ি হয়ত ছোট হলেও একটা টিভি আর ডিস এন্টেনা পেয়ে যাবেন, কিন্তু রেডিও খুঁজে পাবেন না। দশ শতাংশ মানুষের কাছে আজ আর রেডিও নেই। রেডিও হয়ত অচিরেই আমাদের জন্য এন্টিক পিস হয়ে যাবে। রেডিও ক্লাসগুলিতে স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে সরাসরি টিচারদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। এখন অব্দি যতটি ক্লাস আমাদের শিলচর আকাশবানী কেন্দ্র থেকে হয়েছে, দেখা গেছে, অজ গ্রাম থেকে খুব কম সংখ্যক স্টুডেন্ট টিচারদের কাছে বিষয়ের উপর জানতে চেয়েছে। যে স্কুলের টিচার ক্লাস নিচ্ছেন, সেই স্কুলের কোন ছাত্র- ছাত্রীই হয়ত ওই ক্লাসে অংশ নেন নি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে রেডিও ক্লাসগুলোও অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে। আর ভিডিও ক্লাসের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকারা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা করে সেটি রেকর্ডিং করে গ্রুপে পাঠাচ্ছেন। আমাদের দেশে সরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য মূলত মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপের উপর অনলাইন ক্লাসগুলো নির্ভরশীল। গ্রুপে অডিও কিংবা ভিডিও রেকর্ডিং পাঠিয়ে আমরা দায় শেষ করছি। প্রশ্ন হলো, এখানেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে? আমরা কি জানার চেষ্টা করছি, ওগুলো কি এরা ডাউনলোড করতে পেরেছে? ভিডিও কিংবা অডিওগুলো দেখেছে? কতোটা বুঝেছে যা পড়ানো হয়েছে। স্মার্ট ফোন তো অনেকেরই নেই, যাদের আছে, তাদের অধিকাংশের মোবাইলে এতটা স্টোরেজ মেমরি থাকে না , কিংবা এত টাকার নেট প্যাক থাকে না যে, একের পর এক ভিডিও ডাউনলোড করা যায়? তাই ভিডিও কিংবা অডিও ক্লাসগুলো নিয়ে আমরা শিক্ষকরাই একে অপরের তারিফ করি, শিক্ষার্থীদের সাহায্য কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাই এ ক্লাসগুলোও অনেকটাই ব্যর্থ।হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে নোটস দেওয়া নিয়েও একই সমস্যা ।আমরা অনেকেই খাতায় লিখিত প্রশ্নোত্তরের ছবি তুলে গ্রুপে পাঠাই, সেখানেও একই সমস্যা, স্মার্টফোন নেই কিংবা ছবি ডাউনলোড করার মত স্পেস বা নেট নেই। মোবাইলে টাইপ করে নোটস বা প্রশ্ন দিলে এসমস্যার মুখোমুখি শিক্ষার্থীরা হয় না। পড়াতে গিয়ে নিজে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, সেব্যাপারে বলি। স্টুডেন্টদের গ্রুপে আমি কিছু পড়ানোর পর পরীক্ষা নেই। আমি মোবাইলে টাইপ করেই ওদের নোটস কিংবা সাজেশন দেই। দেখেছি বড় একটা প্রশ্নোত্তর কিংবা ৫০ নম্বরের প্রশ্নপত্র টাইপ করে গ্রুপে দিলেও অনেক শিক্ষার্থীরা মোবাইলে পুরোটা পায় না। কারণ তাদের স্মার্টফোন ওতটা স্মার্ট নয়। তাই তাদেরকে ছোট ছোট পার্টে সাজেশন কিংবা প্রশ্নপত্র দিতে হয়। এরকম হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে অনলাইন ক্লাস সিস্টেমকে।

তাহলে কি এটাই বলবো, অতিমারীর এই সময়ে অনলাইন ক্লাস পুরোপুরি ব্যর্থ? ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে কি আমরা দায়মুক্ত হতে পারবো? অবশ্যই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে , মেডিক্যাল – ইঞ্জিনিয়ারিং এসব ক্লাসের স্টুডেন্টদের জন্য অবশ্যই অনলাইন ক্লাস যথেষ্ট গুরুত্ব রাখছে। তারা এই সুবিধাটা কাজেও লাগাতে পারছে। সমস্যাটা হয়েছে মূলত সরকারি স্কুলের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা কলেজ স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য। বেশি মার খাচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা। ল্যাবে প্র‍্যাকটিক্যাল টেস্টিং তো আর অনলাইনে হয় না। তাই তাদের থিওরিতেই শিক্ষাকে সীমায়িত রাখতে হচ্ছে এখন। অঙ্কের ক্লাসেও শিক্ষার্থীরা মার খাবে অনলাইনে। এখন অব্দি আমরা দেখেছি অনলাইন ক্লাসে বিশেষ করে মার খাচ্ছে যারা খেটে খাওয়া মানুষ, যারা প্রান্তিক বাসী। অনলাইন ক্লাস একটা শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টিরও কারণ হচ্ছে। এর প্রমাণ তো তাজা প্রাণের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে আমরা পেয়ে গেছি। আসাম আর কেরলে দুটি ছেলে মেয়ে স্মার্টফোন না থাকার দরুন স্কুলের অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় ভুগতে ভুগতে আত্মহত্যা করলো। এও আমাদের এক বড় ব্যর্থতা। এর দায় নেবে কে? এরপরও কিন্তু আমরা অনলাইন ক্লাসের উপর ব্যর্থতার দায় চাপাতে পারি না। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাইর তো ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বাস্তবায়নকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে যে চুক্তিতে গেছেন, সেখানে পিচাই বলেছেন, ‘It focuses on connecting the 1.2 billion people in India,”…..This will get people rural areas online,low cost of bandwidth, offline strategy, affordable phones will connect more people’ তাহলে এমন প্রত্যাশা করাটা অস্বাভাবিক নয় যে , এমন দিনের দেরি নেই, যখন হয়ত সরকারি প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে ফ্রি মোবাইল তুলে দেওয়া হবে, প্রান্তিক গ্রামে বসেও তারা অফলাইনেও অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে পারবে। তখন ততদিনে অনলাইন ক্লাসকে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে বাস্তবসম্মত কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের এখানে লাইভ ক্লাসরুম এই সময়ে সম্ভব নয়। আমার ভাবনায় রেডিও ক্লাস থেকে রেগুলার দূরদর্শনে ক্লাস বেশি কার্যকর হবে । টিভি আজকাল অজ গ্রামেও আছে। ডিস এন্টেনা হোক, কিংবা ক্যাবল, আঞ্চলিক দূরদর্শন চ্যানেল তো সবাই দেখতে পায়। তাই দূরদর্শনে নির্দিষ্ট কোন এক সময়ে ক্লাস নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা অডিও-ভিসুয়াল ক্লাসের অভিজ্ঞতাটা নিতে পারতো, যা অনেকটা শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর হতো। অনলাইন ক্লাসের জন্য ইউটিউব একটা চ্যানেল রাখা হোক। টিচারদের ভিডিও সেখানে আপলোড করা হোক। শিক্ষার্থীরা সুবিধামত ভিডিও দেখবে , কমেন্টের মাধ্যমে প্রশ্ন করবেন। আর টিচাররা কমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসার উত্তর দেবেন। শিক্ষা সংকটের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বেশি বড় ভূমিকা নিতে পারে স্থানীয় পত্রিকাগুলো। তাদেরও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো রোজ একটি পাতা বা পাতার কিছু অংশ নিদৃষ্ট করতে পারে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য । প্রতিটি দিন কোন না কোন ক্লাসের জন্য নিদৃষ্ট থাকবে। টিচাররা সিলেবাস অনুযায়ী ওই পাতায় লিখিত ভাবে পাঠ বোঝাবেন, নোটস দেবেন। তাহলে মহামারী শেষে কোর্স শেষের ঝক্কিটা অনেক কমে যাবে, শিক্ষার্থীদেরও আর সিলেবাসে হাবুডুবু খেতে হবে না। প্রাইভেট টিউশনের জন্য ভিড় জমাতে হবে না। বুঝতে পারলাম না বরাকের পত্রিকাগুলো এখনো এনিয়ে ভাবলো না কেন? যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করেন, কিংবা শিক্ষাদরদী মানুষ, তারা তো এতদিনে এনিয়ে উদ্যোগ নিয়ে নিতে পারতেন। রোজ যদি পত্রিকায় সিলেবাস নিয়ে আলোচনা, পাঠ বোঝানো আর নোটস দেওয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়ে যাবে। স্থানীয় পত্রিকা তো গ্রামে- গঞ্জে পৌঁছায়। শিক্ষার্থীরা সেগুলো অবশ্যই সংগ্রহ করতো। শিক্ষাবিদ আর শিক্ষাদরদীরা বিষয়টি ভাবতে পারেন।অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে অবশ্যই নিউজ পেপার ক্লাসরুম অনেক বেশি কার্যকর হতে পারবে।

(এই প্রবন্ধের লেখিকা দেবযানী চৌধুরী পেশায় একজন শিক্ষিকা। পূর্বে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন)

Comments are closed.