Also read in

Senior Journalist Pranabananda Das's special write-up after watching 'Noorie'

একটি শিশুকন্যা, তাঁকে জড়িয়ে দু’টি পরিবার, সমাজ, সন্ত্রাস, রাজনীতি এমনকি আজকের অস্থির সময়ের পদধ্বনি। মূলত ব্রহ্মপুত্র থেকে বরাকের বিস্তির্ণ ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে গল্পের শেকড়। আর এই অসাধারণ গল্পকেই নাটকে বদলে দিয়েছেন সাংবাদিক, সম্পাদক এবং হাল সময়ে “অ‍্যাক্সিডেন্টাল নাট্যকার” ( তাঁর নিজের জবানিতে) অরিজিৎ আদিত্য। গত শনিবার (৮ জুন) শিলচরের বঙ্গভবনে অরিজিতের নাটক ‘নুরি’ মঞ্চস্থ করল উপত্যকার পরিচিত নাট্য দল ‘গণসুর’।

আমি একদিকে যেমন নাট্যবোদ্ধা নই, ঠিক তেমনি কোনো নাটকের মান নিয়ে কাটাছেঁড়া করাটাও আমার কম্মের নয়। নিছক একজন দর্শক হিসেবেই এই নাটকটি সম্পর্কে আমার অনুভূতি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।  এই নাটকটিকে ঘিরে গত এক পক্ষকাল ধরেই উপত্যকায় এক আগ্ৰহ তৈরি হয়েছিল। এর মূলে ছিল নাটকটির একটি টিজার। অধ্যাপক জয়দীপ বিশ্বাসের বয়ানে এই টিজারটি ছড়িয়ে পড়েছিল সোস্যাল মিডিয়ায়। অসংখ্য শেয়ার আর ভিউ-এ এই টিজারটি পৌঁছে গিয়েছিল প্রচুর মানুষের কাছে। এই উপত্যকায় কোনো নাটক নিয়ে এমন অডিও-ভিজুয়েল টিজার আগে কখনো হয়েছে কী না তা আমার অন্তত জানা নেই। আর এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল শনিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে। সব আসন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। এমনকি অনেকে দাঁড়িয়েও নাটকটি উপভোগ করেছেন। একটি নাটককে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে এমন আগ্ৰহ বরাক উপত্যকার নাট্য জগতের জন্য অবশ্যই দারুন খবর।

টানা তিন ঘণ্টার নাটক। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয়ে শেষ হল প্রায় দশটায়। আজকাল তো তিন ঘণ্টার সুপারহিট হিন্দি ছবিও খুব একটা দেখা যায় না। সেখানে তিন ঘণ্টার নাটক মঞ্চস্থ করে রীতিমত দুঃসাহস দেখিয়েছেন প্রযোজক সংস্থা। এতে তারা সফলও। ওই তিন ঘণ্টা কিন্তু হলভর্তি দর্শকদের আটকে রেখেছিলেন তারা।

নাটকের গল্প শুরু উজান অসমে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ‘ও মোর আপোনার দেশ’ গাইছে কচিকাঁচারা। এরইমধ্যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারা। অনেকেই মারা যায়। যদিও বলা হয়েছে কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই নাটক, তবে এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ধেমাজিতে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে জঙ্গি সংগঠন আলফার বোমা বিস্ফোরণের সেই বীভৎস ঘটনার।

নাটকটিতে দেখা যাচ্ছে, শিলচরের এক বর্ধিষ্ণু হিন্দু পাড়ায় মধ্যবিত্ত মুসলমান শিক্ষকের পরিবারে বড় হচ্ছে এক শিশু কন্যা। তার নাম-ই নুরি। মা-বাবার বড় আদরের মেয়ে। ভালই চলছিল সংসার। হঠাৎ একদিন নুরির বাবার কাছে আসা একটি ফোন তাদের সুখের সংসারকে তছনছ করে দেয়। ওই ফোন এসেছিল দিসপুর থেকে। রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছ থেকে। তখন বোঝা গেল, নুরি আসলে দত্তক কন্যা। গুয়াহাটির একটি হোম থেকে আইনি নিয়ম মেনে নুরিকে নিয়ে এসেছিলেন ওই মুসলমান দম্পতি। এতদিন ব্যাপারটা কেউ জানতো না। কিন্তু ওই মন্ত্রীর ফোন গোটা গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

আসলে ওই মন্ত্রী ছিলেন প্রাক্তন জঙ্গি নেতা। আত্মসমর্পণ করে রাজনীতিতে পা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। স্বাধীনতা দিবসের ওই অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় জড়িত ছিলেন তিনিও। পরে সেনার অভিযান থেকে বাঁচতে বিদেশে পালিয়ে যান। কিন্তু স্থানীয় এক যুবতীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক থেকে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। তখন ওই জঙ্গি নেতা বিদেশে। অন্যদিকে লোকলজ্জা ও সেনার হাত থেকে বাঁচতে প্রেমিকার বাবা জন্মের চারদিন পরেই শিশুকন্যাকে সমঝে দেন একটি অনাথ আশ্রমে। সেই শিশুটিকেই দত্তক নিয়েছিলেন শিলচরের ওই মুসলমান মাস্টারমশাই।

আত্মসমর্পণ করে সক্রিয় রাজনীতিতে পা দেওয়ার পর ওই প্রেমিকাকেই বিয়ে করেছিলেন সেই জঙ্গি নেতা। কিন্তু বিয়ের পর অনেক চিকিৎসা করালেও তাদের আর সন্তান হয় না। এনিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকে। মানসিক অসুখে ভুগতে থাকেন স্ত্রী। নিজে মন্ত্রী, তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একসময় অনাথ আশ্রম থেকে কন্যাকে কে নিয়ে গিয়েছেন, তার ঠিকানা বের করে ফেলেন নুরির আসল বাবা। তারপরেই ফোন করেন নুরির পালিত বাবাকে।

এরপর নুরিকে নিয়ে টানাপোড়েনেই নাটকের সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে। মন্ত্রী সুলভ চাপের রাজনীতি, ডি ভোটারের নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া, পাড়ার মাস্তানদের বাড়িতে পাঠিয়ে ” হিন্দুর পাড়ায় মুসলমান থাকতে পারবে না” গোছের সাম্প্রতিক ফ্যাশনে হুমকি,…. সবকিছুই ছিল। শেষপর্যন্ত চাপে হার মেনে নুরিকে তার আসল বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজি হন মাস্টারমশাই দম্পতি। সেইমতো মন্ত্রী ও তার স্ত্রী নুরিকে নিয়ে যেতে শিলচরে চলে আসেন। এখানেই নাটকের ক্লাইমেক্স অপেক্ষা করছিল। নুরির মানসিক অবস্থা আর মুসলমান শিক্ষক দম্পতির বাঁধভাঙা হাহাকার দেখে সহ্য করতে পারেননি তার গর্ভধারিনী মা। তাই নুরিকে ছিনিয়ে না নিয়ে ওই শিক্ষক দম্পতির কাছেই ফিরিয়ে দেন। এক আবেগ-বিহ্বল মানবিক বার্তার মাধ্যমেই পর্দা পড়ে নাটকটির।

পরিচালক সুব্রত রায় তাঁর মুন্সিয়ানা নতুন করে দেখিয়েছেন এই “নুরি” নাটকে। এছাড়া তিনি নিজেই নুরির আসল বাবা অর্থাৎ মন্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রদীপ দাস অভিনয় করেছেন মুসলমান মাস্টারমশাই-এর চরিত্রে। মূলত এই দু’জন-ই গোটা নাটককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। বিশেষভাবে নজর কেড়েছেন নুরির পালিতা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা শর্মিলা দত্ত। গোটা চরিত্রের সঙ্গে তিনি নিজেকে এতটাই জড়িয়ে ফেলেছিলেন যে নাটক শেষে সবার সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা গেল তাঁকে। নুরির চরিত্রে অভিনয় করা অনিন্দিতা পালকে দেখেও মনে হল, অনেক লম্বা দৌড়ের ঘোড়া।  মঞ্চ সজ্জা, আলো, সঙ্গীত পরিচালনা, ধ্বনি প্রক্ষেপণ-এ পেশাদারিত্বের ছাপ চোখে পড়েছে।

নাটকটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এটি আসলে সিনেমার চিত্রনাট্য হলে বোধহয় বেশি মানানসই হত। এমন বিশাল ক্যানভাসকে নাটকের মঞ্চে তুলে ধরে গল্পের সঙ্গে কতটা সুবিচার করা হল, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আরো ঘষামাজার সুযোগ রয়েছে। কিছু কিছু জায়গা মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘ হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এর মেদ কাটছাঁট করে কিছুটা কমালে আরো বেশি উপভোগ্য হতে পারে। তবে যেহেতু প্রথম পরিবেশনা, ফলে আগামীতে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়ে গিয়েছে।

সে যাই হোক, এক সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের নাটক “নুরি”। এমন  বিষয়বস্তু নিয়ে নাটক করা যায়, এই ভাবনাই অভিনব। বর্তমান সময়ে যেখানে সব বিষয়-ই ধর্মের আতসকাচের তলায় চলে আসে, সেখানে এমন নাটক ভাবনার খোরাক জোগায়, নতুন করে বাঁচতে শেখায়। এই অস্থির সময়ে এটাও তো কম পাওনা নয়!

Comments are closed.