Also read in

ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সুমন, তার প্রশ্ন "এই পরিস্থিতিতে বাঁচবো কি করে?"

বাবা এবং ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটা খাবার দোকানে কাজ করে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন হাইলাকান্দির সুমন দাস। বাবা, বড় ভাই এবং তার নিজের নামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নোটিশ ছিল। তাদের একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে। বাবা এবং বড় ভাই আগেই মারা গেছেন। তিনি জীবিত রয়েছেন এবং তার নামে নোটিশ আছে, তাই পুলিশ বারবার তাকে দেখা করতে বলছিল। ২০১৯ সালের ৯ মে কাজ থেকে ফেরার পথে থানায় গেছিলেন এবং সেখানেই তাকে আটক করে পুলিশ।

তার স্ত্রী বেশ কিছুদিন জানতেই পারেননি স্বামী কোথায় আছেন। দুধের শিশুকে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এবং শেষমেষ জানতে পেরেছেন স্বামী ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি। গতবছর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে দুই বছর কাটিয়েছেন তাদের জামিনে মুক্তি দিতে। এই সূত্রে সোমবার ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে জামিনে মুক্তি পান সুমন দাস। নিজের সন্তান এবং স্ত্রীকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন, শুধু আবেগ নয় মনের ভেতর ভয় রয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সংসার কিভাবে চলবে!

ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলেন, “আগেই অনেক কষ্টে ঘর সংসার চলছিল, তবে পরিস্থিতি তখন অন্যরকম ছিল। কারাগারের ভেতর বসে জানতে পেরেছি বাইরে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এবার আদালতের নির্দেশ মতে জামিনে মুক্তি পেয়েছি এবং পরিবারের সঙ্গেই বাড়িতে থাকব। তবে এই পরিস্থিতিতে কে আমাকে কাজ দেবে? কোনও রোজগার ছাড়া ছোট সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে কিভাবে থাকব ভেবে পাচ্ছিনা।”

মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, “২০১৫ সাল থেকে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বহুবার আদালতে গিয়েছি এবং নানান নথিপত্র তুলে ধরেছি। আমার বাবা এবং জ্যাঠার ১৯৬৫ সালের রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন ও সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট আছে। আমাদের জন্মের সার্টিফিকেট, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড‌ও আছে। সব তথ্য এবং নথিপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পরেও আমাদের বিরুদ্ধে মামলা। আমার বাবা এই দুঃখ নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন এবং তার রাস্তা ধরেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে বড় ভাই। তবু পুলিশ বা আদালতের চোখে কোনও মায়া-দয়া নেই। জানিনা এভাবে আমি কতদিন বেঁচে থাকতে পারবো।”

সুমন দাসের বয়স ৩০ বছর, বাবার নাম ক্ষিতিশ দাস। থাকতেন হাইলাকান্দির কাঁঠাল বস্তি এলাকায়। বাবার মৃত্যুর পর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে হাইলাকান্দির সন্তোষনগরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন সুমন। হাইলাকান্দি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে একতরফা বিচারে তারা মামলা হেরে যান এবং আদালতের তরফে তাদের বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়। এর আগেই বাবা ক্ষিতীশ দাস এবং বড় ভাই তপন দাস মারা যান।

তার স্ত্রী ববিতা এদিন কারাগার চত্বরে এসেছিলেন স্বামীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য, সঙ্গে ছিল তিন বছরের শিশু। ববিতা বলেন, “বিয়ের পর জানতাম আমার স্বামীর নামে কোর্টে মামলা চলছে। কিন্তু কীসের মামলা, সেটা জানতাম না। আমার স্বামী একটা দোকানে কাজ করতো। হঠাৎ একদিন ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর জানতে পারলাম সে ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছে। কি অপরাধ করে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হয় সেটা আমি জানতাম না। তবে এখন সে মুক্তি পেয়েছে এবং আমরা আবার জীবনকে পুরনো ছন্দে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।”

তার জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন সমাজসেবী কমল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “শুধুমাত্র নথিপত্রের বেড়াজালে আমাদের আশেপাশের অনেক মানুষ অকথ্য যন্ত্রণায় ভোগেন, অনেকেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান। আমরা যতটুকু সম্ভব এই জালে আটকে পড়া ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াই। সুমন দাস প্রায় সর্বহারা, বাবা এবং ভাই চলে যাওয়ার পর অনেক নথিপত্র সে খুঁজেই পায়নি। জামিনে মুক্তি পেলেও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি এটা আমরা জানি। যতদিন মামলা শেষ হচ্ছে না তাকে পুলিশ এবং থানার চক্কর কাটতে হবে। তবে আমরা যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে থাকব।”

তিনি জানান, সুমন দাস ছাড়া এখন শিলচরের কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা ডিটেনশন ক্যাম্পে আরও দুই ব্যক্তি রয়েছেন যাদের দুই বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়া বাকি। এরপর আপাতত ডিটেনশন ক্যাম্পে কেউ থাকছেন না, তবে যারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তাদের মামলা অবশ্যই চলতে থাকবে।

Comments are closed.