Also read in

লকডাউনের সময় ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে নিজের কোম্পানি শুরু করেন শিলচরের যুবক ; এখন পুরো ভারতজুড়ে বাল্ব বিক্রি করছেন

প্রয়োজন মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। একটা দরজা বন্ধ হলে মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় আরেকটা দরজা খুলতে বাধ্য হয়। আর কখনোবা সেই দরজাই জীবনের সাফল্যের পথ খুঁজে দেয়। মিসবাহ উদ্দিন বড়ভূঁইয়ার সঙ্গেও এমনটাই ঘটলো। ব্যাঙ্গালোরে তিনি যে পাওয়ারপ্ল্যান্টে কাজ করতেন তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। গতবছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন ঘোষণার পর ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাছাড়ে নিজের ঘরে ফিরে আসেন। মিসবাহ উদ্দিনও তাদের মধ্যে একজন। তারাপুর রামনগর এলাকার বাসিন্দা মিসবাহ উদ্দিন জানালেন, তার নিয়োগকর্তা এরপর আর তাকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকেননি।

সময়ের স্রোতে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়। আজ মিসবাহ তার নিজস্ব “মা এলইডি বাল্ব” কোম্পানিতে অনেক লোককে নিযুক্তি দিচ্ছেন। ইউটিউব ভিডিও থেকে মিসবাহ বাল্ব ‘এসেম্বোল’ করা শিখেছেন। তার মা ‘রহমত স্বনির্ভর গোষ্ঠী’র রঞ্জনা বেগম বড়ভূঁইয়া আসাম রাজ্য গ্রামীণ জীবিকা নির্বাহ মিশনের অধীনে অনুদান পেয়েছিলেন। এরপর তারা ২০২০ সালের আগস্ট মাসে এলইডি বাল্ব তৈরির ব্যবসা শুরু করেন। “আমার ছেলেটি যখন আমাকে বলেছিল যে তার কোম্পানির নাম আমাকে উৎসর্গ করে ‘মা এলইডি বাল্ব’ রাখতে চায়, তখন সত্যিই সেই মুহূর্তটা আমার জন্য অনন্য হয়ে ওঠে।”

কোন অত্যাধুনিক অফিস ঘর কিংবা এক্সিকিউটিভ হুইল চেয়ার নেই, তবে মিসবাহ এবং তার সাতজনের টিমের একটি ঘর রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে একটা বিছানা, দুটো মেশিন, কিছু পার্টস এবং কিছু পার্সেল যা বাল্ব অ্যাসেম্বল করার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। ইউটিউব থেকে এটি শেখার পর মিসবাহ আরও ছয়জনকে এই পদ্ধতি শেখায়, যারা পরে তার ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। মিসবাহ জানিয়েছেন, আমরা প্রচুর পরিমাণ সামগ্রী অর্ডার দেই।এই সামগ্রী বা উপকরণগুলো দিল্লি থেকে আসে এবং তারপর আমরা এখানে এগুলোকে অ্যাসেম্বল করি। দিল্লি থেকে প্রয়োজনীয় দুটি মেশিনও কিনে আনা হয়েছে।

 

‘মা এলইডি বাল্ব’ মানুষের ক্রোম্পটন, হ্যাভেলস’র মত পছন্দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। “এখানে বরাক উপত্যকায় লোকেরা স্থানীয় জিনিস গুলোর তুলনায় ব্র্যান্ডেড আইটেমগুলো বেশি পছন্দ করেন। তাই আমরা খুব বেশি অর্ডার পাইনা। বেশিরভাগ বিক্রি আমাদের অনলাইনেই হয়ে থাকে।” মিসবাহ আমাদের জানালেন। তার দাবি, তারাপুরে বসে তারা যে বাল্বগুলো তৈরি করেন সেগুলো ব্র্যান্ডেড বাল্ব থেকে বেশি উজ্জ্বল। তারা এক বছরের ওয়ারেন্টি সহ বাল্বগুলো বিক্রি করেন। গত আট মাসে ‘মা এলইডি বাল্ব’এর বারোশো ইউনিটের বেশি বিক্রি হয়েছে। মিসবাহ বলেন, অনলাইনে দেওয়া বেশিরভাগ অর্ডার তামিলনাড়ু আর তারপর গুজরাটের। আমরা কয়েকটা স্থানীয় রিটেইলারের কাছেও বিক্রি করেছি।”

মিসবাহ উদ্দিন এবং তার কোম্পানির জন্য অনলাইন বিক্রি বেশি লাভজনক। তার এই পথচলা এখন পর্যন্ত মসৃণ ভাবে চলছে, তবে তিনি সফল ব্যবসায়ী হতে চান। তিনি জানান, সরকারি অফিস, বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে আলোকসজ্জার সামগ্রী সরবরাহ করতে তারা তৈরি।” সেই টেকনিক আমরা জানি। বাণিজ্যিক অর্ডারের জন্য আমাদের বিভিন্ন উপকরণ সেট অর্ডার করতে হবে, তবে আমরা এটা করতে পারি। একটা বাল্ব অ্যাসেম্বল করতে আমাদের চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে” বললেন মিসবাহ।

তার মা রঞ্জনা বেগম বড়ভূঁইয়া যিনি অনুদান পেয়েছিলেন এবং যার সাহায্যে ‘মা এলইডি বাল্ব’ কোম্পানি শুরু হয়েছিল সেই রঞ্জনা বেগম এই উদ্যোগে মহিলাদের অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখেন। “প্রথমে মহিলারা এখানে কাজ করতে পারেন। এই কাজটি ভালোভাবে শিখে এই কোম্পানিতে নিজেদের অবদান রাখতে পারেন। পরে কাজটি শেখা ভালোভাবে সম্পূর্ণ হলে নিজেরাই এ ব্যবসা করতে পারেন। এভাবেই আমরা সমাজের উন্নয়নে আমাদের নিজেদের অবদান রাখতে পারি এবং কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারি”, বললেন রঞ্জনা বেগম।

 

মিসবাহ এবং তার মা পরবর্তী ফান্ডের সন্ধান করছেন যার সাহায্যে তাদের ব্যবসা আরো বড় হয়ে উঠতে পারে।”আমরা যখন সরকারের কাছ থেকে ব্যবসা শুরু করার জন্য অনুদান পেয়েছি, এখন আমরা বেসরকারি সংস্থাগুলো বা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহের অবস্থানে রয়েছি। এক্ষেত্রে বাজারে আমরা যে এর সম্ভাবনা দেখছি তা বিশাল আকারের। আমরা এখনও অবধি কোন মার্কেটিং করিনি এবং আমরা বিক্রি করতে পারছি। কাজেই যখন আমরা আমাদের প্রোডাক্ট প্রমোট করতে পারবো, অবশ্যই ফলাফলটা ভালো হবে,” মিসবাহ যোগ করেন।

এখান থেকে প্রায় ৩১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করছিলেন মিসবাহ। তার মধ্যে কতটা ক্ষমতা রয়েছে সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। তার কাছে কেবল মাত্র মাসিক বেতন আঠারো হাজার টাকাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি এর বেশির ভাগটাই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। আজ তার নিজস্ব একটি বিজন্যাস রয়েছে, যেখানে তিনি অন্য লোকদের নিয়োগ করছেন। যদিও তারা তার বন্ধু এবং প্রত্যেকেই অন্য আরও কিছু কাজ করছেন‌। তিনি ইতিমধ্যে একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করেছেন এবং তার ফান্ড বাড়ানোর ব্যাপারেও পরিকল্পনা রয়েছে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে তাহলে খুব শীঘ্রই তিনি আরো অনেক কর্মচারি নিযুক্ত করবেন, যারা সম্ভবত তিনি পাওয়ার প্ল্যান্টে যত বেতন পেতেন তার চেয়ে বেশি পাবেন।

Comments are closed.